Tribunalদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় চিটাগাং সিমেন্ট (বর্তমানে হাইডেলবার্গ সিমেন্ট) মামলায় আলোচিত রকিবুর রহমানসহ অন্য ২ আসামী বেকুশুর খালাস পেয়েছেন। একইসঙ্গে কোম্পানিকেও অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালের বিচারক আকবর আলী শেখ এই বেকুশুর খালাসের রায় দিয়েছেন। এ মামলার আসামিরা হলেন ডিএসইর সাবেক প্রেসিডেন্ট রকিবুর রহমান,টিকে গ্রুপের মালিক আবু তৈয়ব এবং বুলবুল সিকিউরিটিজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম শহিদুল হক বুলবুল।

রকিবুর রহমান শেয়ার কেলেঙ্কারীতে আলোচিত নাম। তিনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) কয়েক দফায় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি স্টক এক্সচেঞ্জটিতে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। যার কাছ থেকে সতর্ক থাকার জন্য পরামর্শ দিয়েছিল ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধস উৎঘাটনের তদন্ত কমিটি।

রায়ে বিচারক আকবর আলী শেখ বলেছেন, রকিবুর রহমান ও এ.এস এমশহিদুলহকবুলবুল সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নির্দেশনা অমান্য করে চিটাগাং সিমেন্টে পদ ধরে রাখেন নাই। আর স্টক এক্সচেঞ্জ ছাড়া বিদেশীদের কাছে শেয়ার বিক্রির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। অভিযুক্তরা তাদের আত্মীয়দের কাছে বিপুল পরিমাণ শেয়ার হস্তান্তর করেছেন এমন অভিযোগও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এছাড়া ২.৯২ কোটি টাকা মূল্যের ২২৪০টি শেয়ার দীর্ঘদিন ফরেন অ্যাকাউন্টে আনসেটেলট অবস্থায় থাকার দায়ভার আসামীদের উপর বর্তায় না।

সর্বপরি আসামীরা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ ১৯৬৯ এর ১৭ ধারা লংঘন করে ১৯৯৬ সালে (জুলাই-ডিসেম্বর) শেয়ার কেনা-বেচায় কোন ধরনের কারসাজিমূলক কাজ করেনি বলে বিচারক রায়ে লিখেছেন। এক্ষেত্রে কোন ধরনের অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায়, আসামীদেরকে একই অধ্যাদেশের শাস্তিমূলক ২৪ ধারায় শাস্তি দেওয়া যায় না। যে কারনে আসামীদেরকে খালাস দেওয়া হল বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

এর আগে যুক্তি-তর্ক শেষে ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালের বিচারক হুমায়ুন কবীর রায় ঘোষণার জন্য ওই বছরের ৮ নভেম্বর দিন নির্ধারণ করেছিলেন।কিন্তু রায় ঘোষণার মাত্র ৫দিন আগে ৩নভেম্বর মামলাটির কার্যক্রমের ওপর উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়।

এ মামলার অন্যতম আসামি বুলবুল সিকিউরিটিজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম শহিদুল হক বুলবুলের রিটের প্রেক্ষিতে ৬মাসের স্থগিতাদেশ দেন আদালত।ফলে মামলাটির রায় ঘোষণা করতে পারেননি ট্রাইব্যুনালের বিচারক।এর পরে কয়েক দফায় মামলাটির স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানো হয়।

এদিকে মামলা স্থগিত অবস্থায় থাকাকালীন সময় ২০১৬ সালের ১২ জুলাই বিচারক হুমায়ুন কবীর ট্রাইব্যুনাল থেকে অন্যত্র বদলি হন। এরপরে ১৪ জুলাই ট্রাইবুন্যালেনতুন বিচারক হিসেবে যোগদান করেন আকবর আলী শেখ।

কয়েক দফায় স্থাগিতাদেশের আবেদন করা এএসএমশহিদুলহক নিজেই মামলা চালুর জন্য উচ্চ-আদালতে আবেদন করেন। এর আলোকে ২০১৭ সালের ১০ এপ্রিল স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে মামলা চালুর নির্দেশ দেয় উচ্চ-আদালত।

উচ্চ-আদালতের নির্দেশে ট্রাইবুন্যালে মামলাটি ফের চালু হয়। তবে বিচারক হূমায়ন কবীরের সময় মামলাটির রায় ছাড়া সব কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ায়, নতুন বিচারপতি শুধুমাত্র বাদি ও বিবাদির যুক্তিতর্ক শোনেন। এবং পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ৩০ মে বিচারক আসামীদের বেকুশুর খালাসের রায় দেন।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আইনজীবী মাসুদ রানা খান বলেন, মামলাটিতে বিচারক আসামীদেরকে বেকুশুর খালাস দেন। এক্ষেত্রে আমরা সঠিক বিচার পাইনি বলে মনে করি। যে কারনে এরইমধ্যে উচ্চ-আদালতে আপিল করেছি।

মামলাটিতে সাক্ষীহিসেবে ছিলেন-জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক জহিরুল হক, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মনির উদ্দিন আহমেদ, সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা এমএ রশীদ খানও চিটাগাং সিমেন্টের সাবেক সচিব মোস্তাফিজুর রহমান। আর সাক্ষীর পাশাপাশি বাদি ছিলেন এমএরশীদখান।

এদিকে আসামি আবু তৈয়বের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে ছিলেন খন্দকার মাহাবুব হোসেন ও শেখ মোহাম্মদ আলী। আর রকিবুর রহমান ওএ.এসএম শহিদুল হক বুলবুলের পক্ষেছিলেন মোহাম্মদ মহসিন রশিদ, মো. নূরুল ইসলাম মোল্লা ওএমএ কাদের মোল্লা ছিলেন।

অপরদিকে বিএসইসি বা বাদির পক্ষে আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন মাসুদরানাখান ও আব্দুল্লাহ এম রফিকুল ইসলাম।

মামলার বিবরণে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামিরা ১৯৯৬সালে চিটাগাং সিমেন্টের পরিচালক ছিলেন।ভারতীয় ওই রানি বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির শেয়ার কিনবে বলে আসামিরা মূল্যসংবেদনশীল তথ্য ছড়িয়ে শেয়ার মূল্য প্রভাবিত করেন।এ ব্যাপারে পরবর্তী কালে চিটাগাং সিমেন্টের পক্ষ থেকে সন্তোষজনক কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

এরপর কোম্পানির একজন পরিচালক বড় অংকের শেয়ার হস্তান্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।তবে কী পরিমাণ ও কোন ব্যক্তি একাজ করেছেন তা ১৯৯৬ সালের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই।

এছাড়া বিএসইসির নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও রকিবুর রহমান এবং এএস শহিদুল হক বুলবুল পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেননি।যা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স-১৯৬৯ এর১৭ ধারা অনুসারে কারসাজি বলে মনে করে গঠিত তদন্ত কমিটি।

১৯৯৬ সালের শেয়ার কারসাজির ঘটনা উদঘাটনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আমিরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের ২৬ডিসেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার।তিন মাস পর ১৯৯৭ সালের ২৭মার্চ তদন্ত কমিটি সরকারের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

প্রতিবেদনে চিটাগাং সিমেন্টের শেয়ার কারসাজির বিষয়টি উঠে আসে।আর এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৯৯৭ সালের ৪ মে মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে মামলা করে বিএসইসি।মামলাটি পরবর্তীকালে বিচারের জন্য প্রথম অতিরিক্ত দায়রা আদালত ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়।এই আদালতে থাকাকালীন মামলাটির বাদীর সাক্ষ্য শেষ হয়।

পরবর্তীকালে মামলার আদালত পরিবর্তনের নির্দেশ এলে বাদীপক্ষের সম্মতিতে নিম্নআদালতের আদেশের ওপর স্থগিত আদেশ দেন উচ্চআদালত।এরপর বিএসইসির ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মামলাটি এই আদালতে স্থানান্তর করা হয়।