bankআলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের ব্যাংক খাতে লাগামহীনভাবে বাড়ছে সুদের হার। আর্থিক সংকটের কথা বলে একযোগে সব ব্যাংক আমানতের ওপর সুদের হার বাড়িয়েছে। এ কারণে ব্যবসায়ীদেরও উচ্চ সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। এতে ব্যবসার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে (একক অঙ্কে) নামিয়ে আনার তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সম্প্রতি আওয়ামী লীগের যৌথসভায় ব্যাংকগুলোকে কেবল মুনাফা বৃদ্ধির কথা না ভেবে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে সুদের হার কমিয়ে আনার তাগিদ দেন তিনি। এ অবস্থায় সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে রাখার উদ্যোগ নিচ্ছে ব্যাংকগুলো।

এ প্রসঙ্গে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) সভাপতি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার জন্য আমরা ব্যাংকের মালিকরা চেষ্টা করছি। ব্যাংকের এমডিরা চেষ্টা করছেন। সরকারও চেষ্টা করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বেসরকারি ব্যাংকের তারল্য সংকট কেটে গেলে সুদের হার এক অঙ্কে নেমে আসবে। এজন্য আমরা বিভিন্ন উপায়ে তারল্য সংগ্রহের চেষ্টা করছি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেওয়ার কারণে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, তা দূর হতে বসেছে। ইতোমধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের তহবিলের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণ (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বা সিআরআর ) এক শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর ফলে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে চলে আসবে। এতে তারল্য সংকট কমে গেলে সুদের হারও কমে যাবে।’

জানতে চাইলে ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সিআরআর ও সরকারি আমানত নিয়ে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাতে অচিরেই সুদের হার কমে আসবে।’

তিনি বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংকের মন্দাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ায় ব্যাংক খাতে নগদ টাকার সংকট দেখা দেয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত বেসরকারি ব্যাংকে আসা শুরু হলে এবং সিআরআর এক শতাংশ কমানোর ফলে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো বেসরকারি ব্যাংকগুলোর হাতে চলে এলে সুদের হার কমে যাবে।’

সুদের হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে গত রবিবার রাজধানীর একটি হোটেলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির বৈঠক হয়। বৈঠকে গভর্নর ফজলে কবির, বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা এস কে সুর চৌধুরী, বিএবির সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।

পরে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সুদের হার কমানোর চেষ্টা করছি। এরই অংশ হিসেবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের তহবিলের ৫০ শতাংশ রাখা হবে। ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। আর রবিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর জমা রাখা সিআরআর-এর এক শতাংশ টাকা ব্যাংকগুলো ব্যবহার করতে পারবে। এর ফলে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো বেসরকারি ব্যাংকগুলোর হাতে চলে আসবে। এতে তারল্য সংকট কমে গেলে সুদের হারও কমে যাবে।’

এর আগে জনতা জনতা ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘আগামী একমাসের মধ্যে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হবে।’

অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আগামী একমাসের মধ্যেই সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘দ্রæত সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে আসবে।’ আগামী একমাসের মধ্যে এটা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী বাস্তবসম্মত কথা বলেননি। কিছুটা সময় লাগবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে সব কটিতেই এখন দুই অঙ্কের সুদ গুনছেন ব্যবসায়ীরা। এরমধ্যে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে দেওয়া ঋণের বিপরীতে ১৫ শতাংশেরও বেশি হারে সুদ আরোপ করছে কোনও কোনও ব্যাংক।

এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘ব্যাংক ঋণে সুদের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা বিপদে পড়েছেন। সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনা জরুরি। তা না হলে উচ্চ সুদের ঋণে ব্যবসা করে লাভ পাওয়া কঠিন। সুদের হার বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি ঋণে আগে থেকে সুদ হার দুই অঙ্কে ছিল। এখন স্বল্পমেয়াদি ঋণেও সুদের হার দুই অঙ্কে গিয়ে ঠেকেছে।’ ইএবি সভাপতি মনে করেন, ব্যাংকের খেলাপি প্রবণতা কমানো গেলে সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনা সম্ভব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি মালিকানার আটটি ব্যাংকের মধ্যে জনতা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ব্যবসায়ীরা দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি—দুই ধরনের ঋণেই সুদের হার গুনছেন ১৩ শতাংশ হারে।

একইভাবে ব্যবসায়ীদের উচ্চ সুদ হার গুনতে হচ্ছে শিল্পের মেয়াদি, চলতি ও এসএমই ঋণের ক্ষেত্রেও। সোনালী ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুদ নিচ্ছে ১১ শতাংশ হারে। অগ্রণী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) সুদ নিচ্ছে ১১ থেকে ১২ শতাংশ হারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শিল্পঋণের ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেশি হারে সুদ আরোপ করছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। ২০ শতাংশেরও বেশি হারে সুদ আরোপ করছে কোনও কোনও ব্যাংক।

ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, যেসব ব্যবসায়ী ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন তাদের কারও কারও সুদ গুনতে হচ্ছে ২২ শতাংশ হারে। বেসরকারি অধিকাংশ ব্যাংক এসএমই বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে সুদ নিচ্ছে ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ হারে। বড় উদ্যোক্তাদেরও দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি দুই ধরনের ঋণেই সুদ গুনতে হচ্ছে ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ হারে।

সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ঋণে সুদ হার না বাড়ানোর অনুরোধ জানান তিনি। সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘ব্যাংক ঋণের সুদ হার বেড়ে যাওয়া ব্যবসার জন্য নেতিবাচক। এমনকি দেশের জন্যও তা খারাপ।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গতবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০টির বেশি ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়েছে। এ বছরের জানুয়ারিতে সুদের হার বৃদ্ধি করেছে বাকি ব্যাংকগুলো। গত মাস (ফেব্রæয়ারি) থেকে ৫৭টির মধ্যে সবকটি ব্যাংকই দুই অঙ্কে সুদ নিচ্ছে। প্রতিবেদনটিতে আরও জানানো হয়েছে, শিল্পের জন্য এককভাবে সব ব্যাংক ব্যবসায়ীদের দুই অঙ্কের সুদে ঋণ দিলেও গড় হিসাবে (কাগজে-কলমে) কিছু ব্যাংকের সুদ হার এখনও দেখাচ্ছে ৯ শতাংশের ঘরে। গত জানুয়ারিতে ১৯টি ব্যাংকের সুদ হার গিয়ে ঠেকে গড়ে দুই অঙ্কের ঘরে।

এদিকে, ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) সীমা কমিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে। এজন্য আমানত সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় নেমেছে ব্যাংকগুলো। আমানতের সুদের হারও বাড়িয়ে দিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। ৩ থেকে ৬ শতাংশ থেকে উঠে এখন ১২ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে ব্যাংকগুলো।