insider lagoসাজিদ খান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে কারসাজির রোধে সরকারের নির্দেশে ‘সার্বক্ষণিক যৌথ ইন্সপেকশন দল’ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ কমিটির কোনো উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি। বাজার তদারকির লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামার ঘোষণা দিলেও তা কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ রয়েছে।

পুঁজিবাজারে ২০১০ সালের মহাধসের পরিপ্রেক্ষিতে ইব্রাহীম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে সার্বক্ষণিক যৌথ ইন্সপেকশন দল গঠন করা হয়।  বিশেষ করে ধস পরবর্তী পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে এবং বাজারকে কেউ যাতে মেনুপুলেট করতে না পারে সে জন্যই এ দল গঠন করা। কিন্তু দল গঠন করা হলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তা আস্থা যোগাতে পারেনি।
২০১২ সালের ৩ জানুয়ারি সার্বক্ষণিক যৌথ ইন্সপেকশন দলের সদস্যদের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।

পাশাপাশি ওই গেজেটে দলটির কার্যপ্রণালীর বর্ণনা দেওয়া হয়। গেজেট প্রকাশের পর সার্বক্ষণিক যৌথ ইন্সপেকশন দল পুঁজিবাজারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার স্বার্থে প্রথম বৈঠক করে ২০১২ সালের ১৬ মে। তারপর থেকে এ দলটি আর কোনো বৈঠক করেনি। ওই দিন থেকে থেমে যায় তাদের কার্যক্রম।

সাম্প্রতিক বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে না হতে ফের কারসাজি চক্র সক্রিয় রয়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি বলছে তাদের শেয়ারের দর বাড়ার পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। অথচ ওই কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়ছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। এ তালিকায় এমন কোম্পানিও আছে যেগুলো বছরের পর বছর লোকসান গুনছে। বাজার বিশ্লেষকরা এমন অবস্থাকে ইনসাইডার ট্রেডিং বা কারসাজি করে শেয়ারের দাম বৃদ্ধি বলে অভিহিত করেছেন, যার সর্বশেষ ক্ষতির শিকার হন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

ডিএসইর সাবেক প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে জানান, পুঁজিবাজারে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে শেয়ারের দাম বাড়ানো বা ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে আইনগত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পুঁজিবাজারে কারা এ ধরনের কার্যক্রম চালায় তা চিহ্নিত করা কঠিন। যদি তা চিহ্নিত করা সম্ভব হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিধান রয়েছে। আর সময় সময় যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে সেসব কোম্পানিকে কেন দাম বাড়ছে কারণ জানতে চেয়ে নোটিশ করা হচ্ছে।

page 1 (51)পুঁজিবাজার বিশ্লেষক দেবব্রত কুমার সরকার জানান, পুঁজিবাজারের এমন অবস্থা প্রায়ই হয়ে থাকে। মূলত যখন পুঁজিবাজার ভালো অবস্থায় থাকে তখন এটি সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এটিকে ইনসাইডার ট্রেডিং হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ইনসাইডার ট্রেডিং হচ্ছে কোম্পানির কোনো গোপন খবর পুঁজিবাজারে প্রকাশ না করে নিজেদের মধ্যে লেনদেন করা কিংবা কোম্পানির এমন কোনো খবর যা কোম্পানির জন্য ইতিবাচক তা আগাম বাজারে প্রচার করা। য

দিও তালিকাভুক্ত কোম্পানির যে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রথমে ডিএসইর ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের অবহিত করার বিধান রয়েছে। সেটি না করে প্রথমে তা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে প্রচার করে তারা সিংহভাগ শেয়ার ক্রয় করে। তারপর তা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে ডিএসইতে প্রচার করা হয়।

তখন সেই তথ্যে আকৃষ্ট হয়ে যখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ক্রয় করতে থাকেন তখন বেশি দামে সিন্ডিকেট সেগুলো বিক্রি করতে থাকে। তিনি বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের তথ্য প্রকাশ না করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মুনাফা বা লভ্যাংশের বড় অংশ গ্রহণের সুযোগ করে দেয়া হয়, যা আইনগতভাবে সম্পূর্ণ অবৈধ।

আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ খান দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, গত সাত বছর আগে ধসের পর বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু সংস্কার আনা হলেও সুবিধাভোগী লেনদেন বা ইনসাইডার ট্রেডিং বন্ধে কঠোর আইন না থাকায় আস্থার সংকট কাটেনি বিনিয়োগকারীদের।

এই ইনসাইডারদের তথ্যের ভিত্তিতে পুঁজিবাজারে অনেক অনিয়ম হয়। এ বিষয়ে আইন থাকলেও তা অত্যন্ত দুর্বল; এ আইনের মাধ্যমে ইনসাইডারদের চার্জশিটের আওতায় আনা যায় না।” যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরের উদাহরণ অনুসরণ করে বাংলাদেশে ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’ বন্ধে আরও কঠোর আইন করার ওপর জোর দেন আরিফ খান।

“আমাদের আইনটাকে ব্যাপক পরিবর্তন করে ইনসাইডার ট্রেডিং যারা করে, তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এগুলো করলে পুঁজিবাজারের উপর সাধারন মানুষের আস্থা আরও বাড়বে।”

বাজার বিশ্লেষনে দেখা গেছে, পুঁজিবাজারে গত দুই মাসে প্রায় ১০ টি কোম্পানির শেয়ারের দর অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে, যেগুলোর দামবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। কিছু কিছু কোম্পানি কারসাজির মাধ্যমে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এমনকি এক মাসের মাথায় শেয়ার দর ১০০ শতাংশের মতও বাড়ছে। তেমনি এক কোম্পানি সোনালী আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।

গত ১৩ কার্যদিবস রোববার পর্যন্ত কোম্পানিটির দর বেড়েছে ৩৯ শতাংশ বা ৭৮ টাকা ৩০ পয়সা। দর বাড়ার কোনো কারণ নেই বলে জানিয়েছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। তবুও টানা দর বাড়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের সংশয় দেখা দিয়েছে। পুঁজিবাজারে আরেক লোভনীয় শেয়ারের নাম মুন্নু জুট স্টাফলার্স।

কারণ গত ২৯ মার্চের পর থেকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে ৯ কার্যদিবসই শেয়ারটিতে বিক্রেতা সংকট ছিল। এর মধ্যে গত ৯ এপ্রিল শুধুমাত্র বিক্রেতা ছিল। ওই্ দিন শেয়ারটির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ৫৫ হাজার ৬শ শেয়ার লেনদেন হয়েছে। তবুও শেয়ারটির আগের দিনের চেয়ে প্রায় সর্বোচ্চ দরবৃদ্ধির কাছাকাছি দর বেড়েছিল। শেয়ারটির দর গত এক মাসে প্রায় ৯০ শতাংশ দর বাড়ছে।

নির্ভরশীল সূত্রে জানা গেছে, মুন্নু গ্রুপের আরও একটি শেয়ার মুন্নু সিরামিকের দর ৪২ টাকা থেকে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ১৬২ টাকায় উঠানোর ক্ষেত্রেও একটি সিকিউরিটিজ হাউজও জড়িত রয়েছে। গত ৯ এপ্রিল মুন্নু স্টাফলার্সের সর্বোচ্চ লেনদেনের দিনে একটি ব্যাংকের সিকিউরিটিজ হাউজ তাদের নিজস্ব পোর্টফলিওতে শেয়ারটির ৯ হাজার শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে। এর বিপরীতে একই দিনে স্টাফলার্সের প্রায় ১৭ হাজার শেয়ার কেনা হয়।

এই কোম্পানিটির সাম্প্রতিক দরবৃদ্ধির পেছনে ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ নামের আরও একটি ব্রোকারেজ হাউসের ভ‚মিকা রয়েছে। সেখান থেকেও একদিনে প্রায় ৯ হাজার শেয়ার কেনা হয়েছিল। পরবর্তীতে একক ক্রেতার ভ‚মিকায় দেখা গেছে গ্লোব সিকিউরিটিজকে। ব্যাংকের সিকিউরিটিজ হাউজের পাশাপাশি এই দুটি ব্রোকারেজ হাউসেই ক্রেতার ভ‚মিকা থাকতে বেশি দেখা গেছে।

মুন্নু গ্রুপের এই দুই কোম্পানি মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আগেই জেনে গত ৯ মাসে ধরে বাজারের একটি চক্র বিপুল টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। স্পটত সেখানে সিরিয়াল ট্রেডিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। যা সবারই নজরে এসেছে। কিন্তু কমিশনের সেদিকে কোন খেয়াল নেই।

জানা গেছে, ২০১০ সালেও শেয়ারটির সর্বোচ্চ দর উঠেছিল ৩৭০ টাকা। সেই শেয়ারের বাজারদর এখন দেড় হাজার টাকা। চলতি তৃতীয় প্রান্তিকের প্রতিবেদন প্রকাশের দিন কোম্পানিটির পক্ষ থেকে ৩০০ শতাংশ রাইট শেয়ারের ঘোষণা আসবে এমন গুজবে শেয়ারটির দর বাড়ছে। বর্তমানে এ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৪৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের কোম্পানিটিতে শেয়ার রয়েছে চার লাখ ৬০ হাজার। এর মধ্যে ২ লাখ ৮ হাজার শেয়ার ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে।

এদিকে আরেক কোম্পানির শেয়ার গুজব ছড়িয়ে হু হু করে বাড়ছে। গত মঙ্গলবার সোনালী আঁশের শেয়ার সর্বশেষ ৩১৩ টাকা  ৫০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। এদিকে টানা দর বাড়ায় বিষয়টি অস্বাভাবিক বলে মনে করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। আর এ কারণে সংস্থাটির পক্ষ থেকে দর বাড়ার কারণ জানতে কোম্পানিটিকে নোটিস প্রদান করে। জবাবে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দর বাড়ার কোনো ধরনের মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।

এ সম্পর্কে সোনালি আঁশের কোম্পানি সচিব মকসুদ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, ‘কী কারণে শেয়ারদর বাড়ছে তা আমাদের জানা নেই। এ বিষয়টি আমরা স্টক এক্সচেঞ্জকেও জানিয়েছি।’

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘ মন্দার পর বাজার চলতি মাসের প্রথম দিকে কিছুটা ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। আর এ সময় কিছু স্বল্পমূলধনি কোম্পানির দর বাড়ছে। এসব কোম্পানির শেয়ারসংখ্যা কম থাকায় কোনো চক্র তা নিয়ে নড়াচড়া করতে পারে। তবে সোনালি আঁশের দর বাড়ার পেছনে কোনো চক্র জাড়িত কি না তা নিয়ন্ত্রক সংস্থার খতিয়ে দেখা উচিত।

একাধিক বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, বাজার যখন ইতিবাচক ধারায় ফিরতে চেষ্টা করছে তখন কিছু কোম্পানির দর লাফিয়ে বাড়ছে। অথচ তাদের দর বাড়ার পেছনে কোনো কারণ নেই। তবুও কী কারণে দর বাড়ছে তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার। যদি এভাবে দর বাড়তে থাকে তখন শেয়ার অতিমূল্যায়িত হয়। আর তাতে বিনিয়োগকারীরাই ক্ষতির শিকার হয়।

রয়েল সিকিউরিটিজ হাউজে ট্রেড করেন আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, বাজারের উত্থান ও পতন দুই সময়েই কিছু কোম্পানির দর অতিমূল্যায়িত হয়। আর এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এসব শেয়ারদর বাড়ার কোনো কারণ না থাকলেও কেন লাফিয়ে বাড়ছে তা খতিয়ে দেখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি দাবি জানাই। এতে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে, তারা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢালাওভাবে বাজার অতিমূল্যায়িত হয়ে গেছে এমন কথা বলা ঠিক হবে না। কারণ এখনও অনেকে কোম্পানির শেয়ারের দাম তুলনামূলকভাবে অনেক নিচেই রয়ে গেছে। তবে কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম অতিমূল্যায়িত হয়ে গেছে।

ইনসাইডার ট্রেডিং হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্টদের আরও হার্ডলাইনে যাওয়া দরকার বলে মনে করছেন তারা।
এদিকে অস্বাভাবিকভাবে কোনো কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধির নেপথ্যে অবশ্যই কারণ আছে বলে মনে করেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, গুজব ছড়িয়ে শেয়ারদর বৃদ্ধি করে হাতে থাকা শেয়ার ছেড়ে দেয় একটি অসৎ চক্র। আর এ বিষয়ে কোম্পানিকে স্টক এক্সচেঞ্জের দেওয়া কারণ দর্শানোর নোটিস ফর্মালিটি রক্ষা ছাড়া কিছুই নয়।

শীর্ষস্থানীয় একটি ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘ডিএসই বা সিএসইর দেওয়া কারণ দর্শানোর উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসিত। তবে এর পাশাপাশি যদি শেয়ার লেনদেনের বিষয়টি নজরদারি করা হতো, তবে দর বৃদ্ধির নেপথ্যে যারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হতো।’

তার মতে, শেয়ারবাজারে কারসাজি মূলত এভাবেই হয়। অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারদর বাড়ানোর নেপথ্যে যারা, তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। একটি স্বাভাবিক মার্কেটের জন্য এ কাজটি আরও জোরালোভাবে করা নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব।