islami-bankফাতিমা জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের কোম্পানি ইসলামী ব্যাংকের একের পর এক বিতর্কের পর এবার নগদ টাকার সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত বছর জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে যে পরিবর্তন শুরু হয় তা এখনো অব্যাহত থাকায় এমন অবস্থায় পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। আর ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের ছাঁটাই আতঙ্ক কাজ করছে।

বিশেষ করে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাঝে এ আতঙ্ক বেশি। কোনো কারণ ছাড়াই স¤প্রতি ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার চাকরি যাওয়ায় এমন অবস্থায় পড়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। তবে ইসলামী ব্যাংক আবারও বড় পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। ব্যাংকটির শীর্ষ পদে থাকা ডজনখানেক কর্মকর্তাকে অচিরেই সরে যেতে হবে। একইসঙ্গে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদমর্যাদা বা তার ওপরের শতাধিক কর্মকর্তার অনেককেই বিদায় নিতে হতে পারে। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে ব্যাংকটির একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করে দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, ইসলামী ব্যাংকের টপ ম্যানেজমেন্টে যারা রয়েছেন, তাদের বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারবিরোধী কর্মকান্ড সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। সেখানে টপ ম্যানেজমেন্টের অনেকের নাম রয়েছে। এছাড়া, ব্যাংকটির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদমর্যাদার তিন শতাধিক কর্মকর্তার বিষয়ে নতুন করে তদন্ত করা হবে।

একটি গোয়েন্দা সংস্থা তাদের বিষয়ে ভেরিফিকেশন (তদন্ত) করবে। এতে সরকারের বিরুদ্ধে কেউ ষড়যন্ত্রকারী আছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখা হবে। জামায়াত বা শিবিরের কোনও পদে কেউ দায়িত্ব পালন করেছেন কিনা সে ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হবে। সা¤প্রতিক কর্মকান্ড খতিয়ে দেখা হবে। প্রত্যেকের রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই বাছাই করা হবে।

ওই পরিচালক আরও বলেন, নতুন করে ভেরিফিকেশন হওয়ার খবরে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। তবে অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড চাপ সৃষ্টি করে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে।

গত ৫ এপ্রিল ইসলামী ব্যাংকের (ম্যানেজমেন্ট) ব্যবস্থাপনা থেকে তিন ডিএমডিসহ শীর্ষ পাঁচ কর্মকর্তা বিদায় নেন। অপসারণ করা হয় অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) মো. শামসুজ্জামান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হাবিবুর রহমান ভুইয়া এফসিএ, ডিএমডি আবদুস সাদেক ভ‚ঁইয়া, ডিএমডি মোহাম্মদ মোহন মিয়া ও সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসইভিপি) আমিরুল ইসলামকে। তাদের মধ্যে এসইভিপি (সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট) ছাড়া বাকি সবার চুক্তির মেয়াদ ছিল এক বছরের।

অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, কয়েকজন কর্মকর্তা বোর্ডের সঙ্গে ভিন্নমতের কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। মূলত মানসম্মান রক্ষার্থে ও জেলে যাওয়ার ভয়ে তারা স্বেচ্ছায় বিদায় নিয়েছেন। ব্যাংকটির অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যেও ছাঁটাই আতঙ্ক কাজ করছে। বিশেষ করে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে এই আতঙ্ক বেশি। এ কারণে ইসলামী ব্যাংকে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এই অস্থিরতার মধ্যে গত মঙ্গলবার পদ ছাড়েন চেয়ারম্যান আরাস্তু খান।

এছাড়া ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়েছেন সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। তারা দুজনেই সরকারের সাবেক সচিব। নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজমুল হাসান ও ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হয়েছেন সামীম মোহাম্মদ আফজাল। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেলিম উদ্দিন নতুন পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন। পরিচালনা পর্ষদের বেশ কিছু কমিটিতেও রদবদল হয়েছে। সেলিম উদ্দিন নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন।

ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আরাস্তু খান হঠাৎ করেই পদত্যাগ করার পর নতুন করে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। চাকরি হারানোর ভয়ে সবাই আতঙ্কে রয়েছেন। ঠিক কী কারণে চাকরি হারাতে হচ্ছে সেটিও তাদের কাছে অজানা।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকের আমানত ও বিনিয়োগ হার (আইডিআর) বর্তমানে ৯২ শতাংশ হয়ে গেছে যা নির্দেশনার চেয়ে ২ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে ব্যাংকটি বন্ড ছেড়ে ৫০০ কোটি টাকা তোলার যে পরিকল্পনা নিয়েছিল তাও বাস্তবায়ন করতে পারছে না। ফলে ব্যাংকটির অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, নগদ টাকার অভাবে প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারছে না। এক সময় এ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন খাতে ঋণ নেওয়ার জন্য বলা হতো, এখন কর্মকর্তারা ঋণের জন্য আবেদন করলেও তাদেরও ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংকটি।

সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, বর্তমান মোট আমানতের পরিমাণ ৭৬ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে মুদারাবা আমানত ৬৭ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। আর বাকিটা খরচ ছাড়া (কস্ট ফ্রি) আমানত। ব্যাংকটির বিনিয়োগ রয়েছে ৭৭ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা। এ বিনিয়োগের মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগ ৭৪ হাজার ৮৬ কোটি এবং বাকিটা শেয়ার বিনিয়োগ। সে হিসাবে আইডিআর ৯১ দশমিক ৪৬ শতাংশ হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের আমানতের ৮৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারে। তবে সার্বিক আর্থিক সূচক ভালো থাকলে সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা যায়। যদিও সর্বোচ্চ এ হার ১ শতাংশ কমিয়ে ৮৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেসব ব্যাংকের ঋণ ৮৯ শতাংশের বেশি রয়েছে তাদের আগামী বছরের মার্চের মধ্যে এ সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে।

বর্তমানে ব্যাংকটি নগদ টাকার সংকট মেটাতে বিভিন্ন উপায় খুঁজছে। আগামী ২৫ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য বোর্ড সভায় ব্যাংকটির বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএমে) তারিখ এবং শেয়ার হোল্ডারদের কত শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া হবে সে বিষয়ে আলোচনা হবে। এবার শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো নগদ লভ্যাংশ না দিয়ে শুধু বোনাস শেয়ার বা স্টক ডিভিডেন্ড দেওয়া হবে। অন্যদিকে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হিসাবে খাতা কলমে না টেনে অনেক রাইট অফ করে আইডিআর বাড়ানোর কথাও ভাবছে ব্যাংকটির কর্তৃপক্ষ।

এদিকে পুঁজিবাজারে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা হতাশা প্রকাশ করছেন। কারণ, পুঁজিবাজারের অন্তর্ভুক্তির পর থেকে ভালো শেয়ার হিসাবে সবসময় বিনিয়োগকারীরা ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কিনে আসছেন। কিন্তু গত বছরের পরিবর্তন শুরু হওয়ার পর থেকে শেয়ারটির দাম কেবল কমছেই। অন্যদিকে নগদ লভ্যাংশ ও বোনাস লভ্যাংশও গত বছর পাননি তারা।

ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কখন চাকরি চলে যায় এমন আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে। আর কী কারণে চাকরি যাচ্ছে সেটাও কারো কাছেই স্পষ্ট নয়। তুলনামূলক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাঝে এমন আতঙ্ক বিরাজ করছে।

দেশের বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে প্রথম অবস্থানে থাকা এ ব্যাংকে গত বছর জানুয়ারি থেকে পরিবর্তন শুরু হয়। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কমিটির শীর্ষ ৫ জন কর্মকর্তাকে অপসারণ করা হয়। যদিও ব্যাংকের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তারা সবাই পদত্যাগ করেছেন।

এদিকে, ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে। এক সময় এই ব্যাংকটি দেশের বিপদে পড়া ১০ থেকে ১৫টি ব্যাংককে আর্থিকভাবে সহায়তা করতো, এখন সেই ইসলামী ব্যাংক নিজেই নগদ টাকার সংকটে পড়েছে। গ্রাহকরা ব্যাংকটি থেকে ঋণ পাচ্ছেন না। এমন অবস্থায় বেশ কিছু গ্রাহক ব্যাংকটি থেকে আমানত তুলে নিয়েছেন। সব মিলিয়ে ব্যাংকে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

গত বছর ব্যাংকটির মালিকানায় বড় ধরনের পরিবর্তনের পর অস্থিরতা শুরু হয়। ইতোমধ্যে শীর্ষপর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। অনেকে বদলি হয়েছেন। আবার নতুন নিয়োগও দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৬ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিনিয়োগ (ঋণ) ৬৯ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকার। ব্যাংকটির ঋণ-আমানত অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৯১ দশমিক ৪৯ শতাংশ, যা নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি। তারা সীমার চেয়ে এক হাজার ১০৬ কোটি টাকা বেশি বিতরণ করেছে।

ইসলামী ব্যাংকের পরিবর্তন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক দেবাশিস চক্রবর্ত্তী বলেন, ‘যে কোনও ব্যাংক প্রয়োজন বোধ করলে তার অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন করতেই পারে। এছাড়া পদত্যাগ করার অধিকার সবার আছে।’

২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান মুস্তাফা আনোয়ারকে সরিয়ে পরিচালনা পর্ষদের প্রথম সভাতেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন সরকারের সাবেক সচিব আরাস্তু খান। তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান আজিজুল হকও সেদিন পদত্যাগ করেছিলেন। এছাড়া একইদিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।