islami-bankদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: এক সময়ে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার গুড ব্যাংকের তালিকায় থাকা দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড অবশেষে সর্বস্ব হারাতে চলেছে। ইসলামী ব্যাংকের সব বিনিয়োগ বন্ধ, কর্মকর্তাদের মধ্যে ‘ছাঁটাই’ আতঙ্ক চলছে। তীব্র গ্রুপিংয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ব্যাংকটির স্বাভাবিক কর্মকান্ড। ঋণ বিতরণ কবে থেকে চালু হবে তা এখনো অনিশ্চিত।

পাশাপাশি এবার ভালো ডিভিডেন্ড থেকেও বিনিয়োগকারীদের বঞ্চিত করলো ইসলামী ব্যাংক। ইসলামী ব্যাংক বরাবর বিনিয়োগকারীদের ভালো মুনাফা দিয়েছে। মুনাফা ঘোষণার সময় তারা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বিষয়টি মাথায় নিয়েছে। এ কারণে ১৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশ দিয়েছে ব্যাংকটি। কিন্তু গত বছর অতীতের সব রীতি লঙ্ঘন করে ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এবারও এ ধারা অক্ষুন্ন রেখে হতাশ করেছে বিনিয়োগকারীদের।

জানা গেছে, সক্ষমতার অভাবেই ইসলামী ব্যাংক নগদ লভ্যাংশ বাড়াতে পারেনি। ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিতেও ইসলামী ব্যাংকের বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তবে মাত্র ১৬ মাসে ইসলামী ব্যাংকের এ অবনতিতে হতাশ বিনিয়োগকারীরা।

২০১৭ সালের জন্য বিনিয়োগকারীদের নগদ ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। আগামী ২৫ জুন বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) জন্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই সভায় তা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অনুমোদন করা হবে।

এদিকে ইসলামী ব্যাংকের লভ্যাংশ ঘোষণা নিয়ে বিনিয়োগকারীরা হতাশা প্রকাশ করেছেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের দর আরও কমিয়ে আনতে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিনা। তারা ইসলামী ব্যাংকের সক্ষমতা কমে যাওয়ায় তারা সংশয় প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বলছেন, মাত্র ১৬ মাসে ইসলামী ব্যাংকের এমন অবস্থা হওয়ার কথা নয়।

ঢাকার বিনিয়োগকারী আজগর আলী বলেন, গত বছর ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ার পর ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ১৫ টাকা কমেছিল। এ বছর দর সেভাবে কমলে বাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে ইসলামী ব্যাংকের লভ্যাংশ দেওয়া উচিত ছিল।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একজন বিনিয়োগকারী বলেন, ঘোষিত লভ্যাংশ ব্যাপকভাবে হতাশ করেছে পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, যেখানে বরাবরই ব্যাংকটি বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ মুনাফা করে আসছে, সেখানে এমন লভ্যাংশ ঘোষণা বাজারের প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ বিনিয়োগকারীকে এক ধরনের বঞ্চিত করার শামিল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মালিকানা পরিবর্তনসহ বেশকিছু কারণে ইসলামী ব্যাংকের ওপর গ্রাহক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমছে। এ পরিস্থিতিতে প্রত্যাশিত লভ্যাংশ না দেওয়ার কারণে ব্যাংকটি আরও পিছিয়ে পড়বে। পুঁজিবাজারের ওপরও এর বড় প্রভাব পড়বে। বেসরকারি খাতের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকটির লভ্যাংশের হার না বাড়া দুঃখজনক বলেও মনে করছেন তারা।

তবে লভ্যাংশের হার না বাড়ার কারণ সম্পর্কে ইসলামী ব্যাংকের সদ্য পদত্যাগী চেয়ারম্যান আরাস্তু খান এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। সেলফোনে যোগাযোগ করা হলে ‘আমি এখন আত্মীয়ের বাড়িতে আছি’ বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। একইভাবে ব্যাংকটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ও কোম্পানি সচিব এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে রাজি হননি।

১৯৮৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পর ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করলেও পরের বছরগুলোয় কমবেশি বেড়েছে কোম্পানিটির লভ্যাংশ। ২০০০ সালের পর কখনও তা ২০ শতাংশের নিচে নামেনি। ২০১০ সালে তা সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশে পৌঁছায়।

এছাড়া ডিএসই থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০০৩ থেকে ২০১৩ সালের অন্য বছরগুলোয় ইসলামী ব্যাংক ঘোষিত লভ্যাংশ ছিল ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে। এর মধ্যে বেশিরভাগ অর্থবছরে ২৫ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ ঘোষণা করে ব্যাংকটি। সর্বশেষ ২০১৫ অর্থবছরে কোম্পানিটির লভ্যাংশের হার ছিল ২০ শতাংশ নগদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘পুঁজিবাজারের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলোর দিকে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকে। প্রত্যাশা পূরণ না হলে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। যার প্রভাব বাজারের লেনদেনের ওপরও পড়ে। তাই কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ ঘোষণার সময় এ দিকগুলো বিবেচনায় নিতে হয়। ইসলামী ব্যাংকের লভ্যাংশ ঘোষণার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য আমি এখনও পাইনি। এ নিয়ে কোনো মন্তব্যও করতে চাই না।’

ব্যাংকের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৬ সালে ব্যাংকটি কর-পরবর্তী মুনাফা করেছিল ১৫১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ওই হিসাববছরের জন্য বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিয়েছিল ১০ শতাংশ। এ ঘোষণার পরই ৪৬ টাকায় থাকা ব্যাংকের শেয়ারদর এক পর্যায়ে ২৬ টাকায় নেমে যায়। এর প্রভাবে পুরো ব্যাংক খাতসহ পুঁজিবাজারে ধস নেমে আসে।

সূত্রমতে, সর্বশেষ হিসাবে ইসলামী ব্যাংকের কাছে বর্তমান মোট আমানত রয়েছে ৭৬ হাজার ৪৯৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৬৭ হাজার ৫৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা মুদারাবা হিসাবে ও অবশিষ্ট প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার আমানত কোনো প্রকার খরচ ছাড়া সংগ্রহ করেছে। এর বিপরীতে ব্যাংকটি ঋণ দিয়েছে ৭৭ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা। যার মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগ হয়েছে ৭৪ হাজার ৮৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকার। অন্যদিকে শেয়ারে বিনিয়োগ করেছে বাকি প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার।

অন্যদিকে নগদ টাকার তীব্র সংকটের কারণে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড সব ধরনের বিনিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। আগে মৌখিকভাবে বিনিয়োগ বন্ধের কথা বলা হলেও গত রোববার ব্যাংকের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সুইচ বন্ধ করে দিয়ে বিনিয়োগ বন্ধ করা হয়েছে। নগদ টাকার সঙ্কট মেটাতে কোনো ব্যাংকের বিনিয়োগ এভাবে বন্ধ করে দেয়ার এ ঘটনা দেশের ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন ঘটনা। দেশের কোনো জায়গা থেকে বিনিয়োগ (ঋণ) দিতে পারেনি ব্যাংকের শাখাগুলো।

ইসলামী ব্যাংকের জনপ্রিয় সেবা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আউটলেট দেয়ার কার্যক্রমও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ব্যাংকটির এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ১০৫টি আউটলেটের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ৯৫টি আউটলেট চালু হয়েছে। বর্তমানে নতুন আউটলেট উদ্বোধন বন্ধ রেখেছে ব্যাংকটি।

দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়ায় এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আরো ২০০টি আউটলেটের অনুমোদন চেয়েছিল ব্যাংকটি। বিনিয়োগসহ প্রয়োজনীয় সেবা বন্ধ রাখার পাশাপাশি ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে এখনো ‘ছাঁটাই’ আতঙ্ক কাজ করছে। এতে ব্যাংকটি এক প্রকার স্থবির হয়ে পড়েছে। তবে আমানতকারীদের কাছ থেকে আমানত গ্রহণ ও প্রদান ঠিক রয়েছে বলে ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

নগদ টাকার সঙ্কট মেটাতে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত আমানত ও বিনিয়োগ হার (আইডিআর) ঠিক করার জন্য বিনিয়োগ বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। পরিচালনা পষর্দের এমন সিদ্ধান্তে ব্যাংকটির সংকট আরো ঘনীভূত হতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত বছর জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে যে পরিবর্তন শুরু হয় তা চলতি মাসেও অব্যাহত থাকায় ব্যাংকটি নানান সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীরবতায় হতাশা প্রকাশ করেছেন আমানতকারীরা। তাদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বেচ্ছাচারিতায় ব্যাংকটি সর্বস্বান্ত হচ্ছে।

ফরিদুল হাসান নামে একজন আমানতকারী জানান, ব্যাংকটিতে তার পরিবারের লোকজনের কয়েক কোটি টাকা আমানত রয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকটির যে হাল তাতে তিনি বেশ উদ্বিগ্ন।

তিনি বলেন, এক সময় ইসলামী ব্যাংক শুধু বাংলাদেশ নয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও শীর্ষ ব্যাংক ছিল। আমরা সে কারণেই আমানত রেখেছি। গত দেড় বছরে ব্যাংকটিতে যে অপকর্ম চলছে তা দেখেও না দেখার ভান করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে আমরা বেশ হতাশ হয়ে পড়েছি।

প্রশ্ন উঠেছে, এসব অপকর্মে কি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও জড়িত। তা না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব অপকর্মকে বৈধতা দেয় কিভাবে? ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান হাল ও বিনিয়োগ বন্ধ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র দেবাশিষ চক্রবর্তী বলেন, এটি একান্তই ইসলামী ব্যাংকের পষর্দের বিষয়।

গ্রাহকের চাহিদা ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগ বিষয়ে ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি কিছু বলার নেই। এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তই গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, ব্যাংকের আমানত ও বিনিয়োগ হার (আইডিআর) বর্তমানে ৯২ শতাংশ হয়ে গেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিত হারের চেয়ে ২ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে ব্যাংকটি বন্ড ছেড়ে ৫০০ কোটি টাকা তোলার যে পরিকল্পনা নিয়েছিল তাও বাস্তবায়ন করতে পারছে না।

ফলে ব্যাংকটির অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, নগদ টাকার অভাবে প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারছে না। এক সময় এ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন খাতে ঋণ নেয়ার জন্য বলা হতো, এখন কর্মকর্তারা ঋণের জন্য আবেদন করলেও তাদেরও ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংকটি। ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান মোট আমানতের পরিমাণ ৭৬ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে মুদারাবা আমানত ৬৭ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। আর বাকিটা খরচ ছাড়া (কস্ট ফ্রি) আমানত। ব্যাংকটি বিনিয়োগ রয়েছে ৭৭ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা। এ বিনিয়োগের মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগ ৭৪ হাজার ৮৭ কোটি এবং বাকিটা শেয়ার বিনিয়োগ।

সে হিসাবে আইডিআর ৯১ দশমিক ৪৬ শতাংশ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের সংগৃহীত আমানতের ৮৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারে। তবে সার্বিক আর্থিক সূচক ভালো থাকলে সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা যায়।

যদিও সর্বোচ্চ এই হার এক শতাংশ কমিয়ে ৮৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেসব ব্যাংকের ঋণ ৮৯ শতাংশের বেশি রয়েছে তাদের আগামী বছরের মার্চের মধ্যে এই সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে।

হঠাৎ করে আবারো বড় ধরনের পরিবর্তনে ইসলামী ব্যাংক নিয়ে সর্বমহলে চলছে নানা কানাঘোষা। আরাস্তু খান গত মঙ্গলবার ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় পদত্যাগপত্র জমা দেন। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি পদত্যাগের কথা জানান।

পদত্যাগের পর ইসলামী ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে চেয়ারম্যান আরাস্তু খানের ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হয়েছে ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজমুল হাসানকে।