textileজয়নাল আবেদিন ও মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি শুধু কেবল আইনেই আছে। বাস্তব চিত্রে এর প্রয়োগের মাত্রা খুবই কম। ফলে বস্ত্র খাতের শ্রমিকদের মাঝে মে দিবসে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। বর্তমানে প্রায় ৪৪ লাখ শ্রমিক কাজ করেন দেশের পোশাক খাতে।

শিল্পের শুরু থেকে এ খাতে নারী শ্রমিকের আধিক্য ছিল। গবেষণায় দেখা গেছে, আগে পোশাক খাতে ৮০ শতাংশের বেশি নারী শ্রমিক কাজ করলেও বর্তমানে এ হার ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। এ নারী শ্রমিকরা কারখানায় বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হন এ অভিযোগ অনেক পুরনো। সা¤প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী কারখানায় নারী শ্রমিকের ৮৫ শতাংশ শিকার হন মৌখিক হয়রানির।

চলতি বছর জানুয়ারি মাসে ‘স্টেট অব রাইটস ইমপ্লিমেনটেশন অব উইমেন রেডিমেড গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। কেয়ার বাংলাদেশের সহযোগিতা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে কর্মজীবী নারীর উদ্যোগে ‘ঐক্য’ প্রকল্পের আওতায় তৈরি পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকের কর্মপরিবেশের ওপর গবেষণাটি করা হয়েছে।

সংখ্যাগত পদ্ধতি (কোয়ান্টিটেটিভ অ্যাপ্রোচ) ব্যবহার করে ঢাকা ও গাজীপুর এলাকার মোট ১৫০ নারী শ্রমিকের ওপর জরিপ চালিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশে মৌখিক, যৌন, মানসিক ও শারীরিক এ চার ধরনের হয়রানির শিকার হন নারী শ্রমিক।

৮৪ দশমিক ৭ শতাংশ নারী শ্রমিক শিকার হন মৌখিক হয়রানির। যৌন হয়রানির শিকার হন এমন নারী শ্রমিক ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। ৭১ দশমিক ৩ শতাংশ নারী শ্রমিক মানসিক হয়রানির শিকার হন কর্মপরিবেশে। আর শারীরিক হয়রানির শিকার নারী শ্রমিকের ২০ শতাংশ।

গবেষণা কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন। তিনি বলেন, আগের চেয়ে পরিস্থিতি ভালো হলেও কারখানায় কর্মপরিবেশে নারী শ্রমিকদের হয়রানি করা বন্ধ হয়নি। পরিস্থিতি এমন যে, বিশেষভাবে কোনো স্পর্শ যে যৌন হয়রানি হতে পারে, সেই বিষয়টিও অনুধাবন করতে পারেন না নারী শ্রমিক। এ বিষয়গুলো নজরদারি ও তদারকির আইনি সংস্থা কল-কারখানা অধিদপ্তর। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) সঙ্গে। সংস্থাটির অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ড. মো. আনোয়ার উল্লাহ বলেন, শ্রম আইনে সুস্পষ্ট বলে দেয়া আছে শ্রমিকের যেকোনো ধরনের হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ গঠন করা যাবে। এ অভিযোগ গঠনের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। কারখানায় অ্যাবিউজ হওয়া শ্রমিক যদি নাম প্রকাশ না করেও অভিযোগ গঠন করেন, সে বিষয়ে পদক্ষেপ আমরা গ্রহণ করব।

গবেষণায় নারী শ্রমিকের কাজের চুক্তিসংক্রান্ত বিষয়গুলোর দুর্বল পরিস্থিতি উঠে এসেছে। অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার, পে ¯িøপ, অ্যাটেনডেন্স কার্ড, আইডেনটিটি কার্ড, সার্ভিস বুক থাকার মতো আইনি বাধ্যবাধকতাগুলো যথাযথভাবে পালন করা হয় না। দেখা গেছে, ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ নারী শ্রমিক অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার পান না, আইডেনটিটি কার্ড পান না ২৪ দশমিক ৭ শতাংশ, পে ¯িøপ পান না ৩২ শতাংশ, সার্ভিস বুক পান না ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ এবং অ্যাটেনডেন্স কার্ড পান না ১ দশমিক ৩ শতাংশ নারী শ্রমিক।

মে দিবসের শোভাযাত্রায় নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটির দাবিতে প্ল্যাকার্ড বহন করছেন এক নারী শ্রমিক রোকসানা (২০)। বিয়ে হয়েছে দুই বছর হলো। স¤প্রতি এক সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। ১৬ বছর বয়স থেকেই কাজ করতেন গার্মেন্টসে। ২০১৭ সালে গর্ভধারণের তিনমাস পরেই চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। আট মাস কাজ ছাড়া থেকে দুই মাসের সন্তান রেখে আবারও কাজে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন।

মাতৃত্বকালীন চার মাসের ছুটি ও পাওনাদি না নিয়ে তাহলে কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন কেন প্রশ্নে তিনি বলেন, কাজ ছেড়ে দিতে গর্ভবতী শ্রমিক বাধ্য হয়। তাকে যে সিঁড়ি দিয়ে কাজে উঠতে হয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা হয়তো দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, এই জায়গাগুলোতে কেউ ছাড় দিবে না। ফলে এমন অবস্থা তৈরি করে রাখা হয়েছে যাতে এসময়টায় শ্রমিক কাজ ছেড়ে দেয়। আর মালিক বলছেন, শ্র্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি আমরা দিতে চাই, তারা নিতে আসে না। কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যায়।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ৪৫ ধারা অনুযায়ী, অন্তঃসত্ত¡া শ্রমিক, সন্তান প্রসবের আগে ৮ সপ্তাহ এবং প্রসবের পরের ৮ সপ্তাহ, মোট ১৬ সপ্তাহ পূর্ণ মজুরিতে ছুটি পাওয়ার অধিকার রাখেন। মালিক এই ছুটি দিতে বাধ্য।

চাকরিতে এ ছুটি ভোগ করা যাবে সর্বোচ্চ দুইবার। এবং একটি নির্দিষ্ট হারে তার নিয়োগকর্তার কাছ থেকে আর্থিক ভাতা পাবেন। তবে মাতৃত্বকালীন এসব সুবিধা পেতে একজন নারী শ্রমিককে সেই নিয়োগকর্তার অধীনে সন্তান প্রসবের আগে কমপক্ষে ছয় মাস চাকরি করতে হবে। দেশে নারীর কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাকশিল্প।

আইন অনুযায়ী, কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে কর্মরত গর্ভবতী মায়েদের চার মাস ছুটি পাওয়ার কথা। অভিযোগ আছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়েরা এ ছুটি পাচ্ছেন না।সরেজমিনে দেখা গেল পরিস্থিতি ভিন্ন। ছুটি কেউ নিতে যায় না কেননা, শ্রমিকদের অভিযোগ মালিকপক্ষ ছুটি দিতে চায় না।

শ্রমআইনে বেতনসহ চার মাসের ছুটি পাওয়ার কথা থাকলেও গার্মেন্টস মালিকরা তা মানছেন না। তাই, গর্ভধারণের কয়েক মাসের মধ্যে কাজ ছেড়ে দিয়ে যাওয়া শ্রমিক কোনোমতে সন্তান জন্ম দিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন করে কাজে যোগ দিতে বের হন। রাজধানীর বিভিন্ন গার্মেন্টসে কর্মরত মা হওয়া নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে মালিকদের শ্রম আইন অমান্য এবং তাদের অমানবিক আচরণের কথা জানা যায়।

মিরপুর নিবাসী গার্মেন্ট শ্রমিক আকলিমা। ৭ মাসের গর্ভকালীন সময়ে চাকরি ছেড়ে বাসায় আছেন। চার মাসের বেনিফিটসহ ছুটি নিয়ে তার কাজ হতো কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, গর্ভের এ পর্যায়ে এসে আসলে গার্মেন্টের যে কাজের চাপ সেটা নেওয়া সম্ভব না। আর যারা কাজ করার তাদের আচরণও খুব বাজে থাকে। সে কারণে সন্তানের কোনও ক্ষতি না করতে চাইলে কাজ ছাড়ার কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু কাজ আমরা কেউই স্বেচ্ছায় ছাড়ি না।

দেশওয়ান অ্যাপারেলস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল হক বলেন, আমরাতো দিতেই চাই, এখন পর্যন্ত কেউ মাতৃত্বকালীন ছুটি নিতে আসেনি আমাদের কাছে। আমাদের চারমাস দেওয়ার নিয়ম আছে, কিন্তু শ্রমিকরা গর্ভধারণের দুই তিন মাসের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দেয় স্বেচ্ছায়। অপারেটিং এ কাজ করে যারা তারা এটা বেশি করে।

কারণ,বাজারে তাদের চাহিদা আছে। আট মাস ছুটি কাটিয়ে তারা যখন আবার নতুন করে চাকরিতে ফেরে তখন সাতশ’ টাকা বেশি বেতনে জয়েন করে।  এই সুবিধাটা নেওয়ার জন্য তারা গর্ভধারণের বিষয়ে কিছু না জানিয়েই চাকরি ছেড়ে চলে যায়।

মালিকরা মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে মিথ্যাচার করে উল্লেখ করে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মালিকরা চার মাসের ছুটি বেনিফিটসহ দিতে চায় না।

বরং নানাভাবে শ্রমিকদের হয়রানি করা হয়।এসব এড়াতে কখনও কখনও শ্রমিকরা বাধ্য হয় চাকরি ছেড়ে দিতে। সেটাকে কি স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেওয়া বলা যাবে? তিনি বলেন, যেসব নারী শ্র্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নয় তারা এগিয়ে না এলেও বেনিফিট পায়নি এরকম অনেক শ্রমিক মামলা করে তাদের দাবি আদায় করেছে এমন উদাহরণও আছে।

মাতৃত্বকালীন ছুটির উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বাচ্চা প্রসবের দুই মাস আগে এবং পরের দুই মাস মিলিয়ে চার মাসের ছুটি পাওয়ার কথা শ্রমিকের। যেসব মালিক ছুটি দেন বলে দাবি করেন তারা এই পুরো সময়টা ছুটি দেন এমন উদাহরণ নেই বললেই চলে। কেউ কম ছুটি দেন কেউ টাকা দিতে চান না। একটা কারখানায় কেউ কোনোদিন মাতৃত্বকালীন ছুটি চাইতে যায়নি এই কথা দিয়েই বোঝা যায় এটা কতটা মিথ্যাচার!