noor fcs -deshprotikhonনূর আহমেদ এফসিএ। আলফা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও। এর আগে কাজ করেছেন ইউনিক গ্রুপ ও বিটিআই এ। আলফা ক্যাপিটালের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। অবদান রাখছে পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানি বাড়াতে। পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের সঙ্গে।

দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ: পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থাকে কীভাবে দেখছেন?

নূর আহমেদ : বাজারের অবস্থা খুব যে সন্তোষজনক তা নয়। আমাদের অর্থনীতির যে আকার, প্রবৃদ্ধির যে হার তার সঙ্গে বাজারের অবস্থা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অবশ্য মাঝখানে বাজার যে মন্দ অবস্থায় ছিল, সেখান থেকে বের হয়ে এসেছে। সরকারের সহযোগিতায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারের বেশকিছু সংস্কার করেছে। নতুন অনেক আইন ও বিধি হয়েছে। বাজারে কয়েকটি নতুন পণ্য চালুর প্রক্রিয়া চলছে। তবে বাজারের গতিশীলতা ও টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য আর্থিক খাতেও সংস্কার দরকার। ওই খাতের বিশৃঙ্খলা থেকে বের হওয়া জরুরি।

দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ: আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা এড়ানোর জন্য সরকার কী করতে পারে?
নূর আহমেদ : প্রথমত, সরকারের একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকতে হবে, কোনোভাবেই করের টাকা দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণ করা যাবে না। তবে যদি বিশেষায়িত কোনো ব্যাংকের হয়, তাহলে মানা যেতে পারে। এর জন্য একটি নীতিমালা জরুরি।

দ্বিতীয়ত, ব্যাংকগুলো পুরোনো ধ্যানধারণা নিয়ে ব্যবসা করছে। শিল্প-মালিকরাও এখান থেকে বের হতে পারছে না। সব ধরনের মূলধনের জন্য আমরা ব্যাংকে ছুটে যাই। বিশ্বে সবচেয়ে নিকৃষ্ট পদ্ধতি হলো এটি। ব্যাংক থেকে পূরণ হবে সিজনাল ক্যাপিটাল গ্যাপ। ব্যবসার মূল টাকা আসতে হবে পুঁজিবাজার থেকে। তবে অনেকে মনে করেন পুঁজিবাজার তো শক্তিশালী না। পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে হবে।

স্বল্প মেয়াদে আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ আমাদের ব্যাংকগুলো বছরের পর বছর এমন কাজই করে আসছে। অন্যদিকে, পুঁজিবাজারের টাকা শিল্পায়নের জন্য গেলে ওই দিকে নজর থাকে অনেক বেশি। ফলে ওই অর্থের সঠিক ব্যবহারে উদ্যোক্তাদের ওপর এক ধরনের চাপ থাকে। কিন্তু সরকারি ব্যাংক থেকে টাকা নিলে সেখানে কমপ্লায়েন্সের বালাই থাকে না। লুটপাটের একটি আখড়া হয়ে যায়। শিল্পায়নের টাকা পুঁজিবাজার থেকেই যাওয়া উচিত।

দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ: তাহলে ঋণকে কীভাবে সিকিউর করা যায়?
নূর আহমেদ : আমি বলেছিলাম ব্যাংক সিকিউরিটি দিয়ে কিন্তু তার লোনকে সিকিউর করতে পারে নাই। বিশ্বব্যাপী দেখা গেছে, ব্যাংকগুলো বিকল্প অর্থায়ন করছে। স¤প্রতি বিএসইসি এ সংক্রান্ত একটি আইন পাস করেছে। বিশ্বব্যাপী এটি অনেক জনপ্রিয় মাধ্যম কিন্তু আমাদের দেশে কোনো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসছে না। সবাই গতানুগতিক ধারায় ব্যবসা করছে, আর ডুবছে।

কিছু টাকা তো এখানে বিনিয়োগ করা যায়। এটি না হলে এই আইনের যথার্থ প্রতিফলন হবে না। আমাদের দেশে এখন কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা অনেক বেশি। এই সুবিধা গত দশ-পনেরো বছর ধরে আছে, আরও আগামী দশ-পনেরো বছর থাকবে। এটা বিশ্বে কয়েকশ বছর পরপর একেক অঞ্চলে আসে। বর্তমানে আমরা ওই সময় পার করছি। এই বিশাল কর্মক্ষম মানুষকে কাজে লাগাতে চাইলে বিকল্প অর্থায়নকে গুরুত্ব দিতে হবে।

দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ: পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করার জন্য কী কী করা যায়?
নূর আহমেদ : পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করার জন্য সরকার অনেক কিছুই করেছে। আরও হয়তো করবে। তবে বাজারে কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না। পুঁজিবাজারকে তার আপন গতিতে চলতে দিতে হবে। সরকারি আমলা বা রাজনৈতিকভাবে কোনো প্রভাব ফেলা যাবে না। বিএসইসিকে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিতে হবে। পর্যাপ্ত জনবল দিতে হবে।

বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় আরও সতর্ক থাকা দরকার। সবাইকে বুঝাতে হবে যে, অন্যায় করে এখানে পার পাওয়া যায় না। ভালো আইপিও আনাটাও জরুরি। ভালো কোম্পানি বাজারে আনার রাস্তা খোলা রাখতে হবে। এখন সময় হয়েছে বহুজাতিক ও সরকারি কোম্পানিগুলোকে বাজারে নিয়ে আসার।

অর্থমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারি মহলের অনেকেই চাচ্ছেন সরকারি কোম্পানিগুলো বাজারে আসুক। কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই বললেই চলে।  কোম্পানিগুলো কেন আসছে না, সমস্যা কোথায় সেটি খুঁজে বের করতে হবে। সরকার কেন ব্যবসা করবে। সরকারের কাজ হলো নীতি প্রণয়ন করা। ব্যবসা করবে ব্যবসায়ীরা।

দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ: সরকারি কোম্পানিগুলো বাজারে না আসার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?
নূর আহমেদ : কোম্পানিগুলো বাজারে না আসার জন্য দায়ী মূলত আমলাতন্ত্র। আমলারা মনে করেন, কোম্পানি পুঁজিবাজারে গেলে তাদের নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে। কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের মনিটরিংয়ের মধ্যে থাকে। তখন যা খুশি তা করা বেশ কঠিন।

এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে আমলাদের ক্ষমতা কমাতে হবে। কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনার জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে এটি করা যেতে পারে। যা করলে আগামী পাঁচ বছরে কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনা যাবে সেটাই করতে হবে।

দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ: দেশে অনেক ভালো ভালো কোম্পানি আছে, যেগুলো পুঁজিবাজারের বাইরে। এসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে না আসার পেছনে কারণ কী বলে মনে হয়?

নূর আহমেদ : অনেকগুলো কারণে ভালো কোম্পানি বাজারে আসছে না। প্রথমত, যখন তার বিনিয়োগের প্রয়োজন, তখন তাকে টাকা পেতে হবে। আইপিও পদ্ধতিটি অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সময় কমানোর জন্য বিএসইসি চেষ্টা করছে। কাজ হচ্ছে না। আইন-কানুনগুলো ব্যবসাবান্ধব করতে হবে। বুকবিল্ডিং পদ্ধতির আইপিওতে রোড শো করার পর যদি একবছর সময় লাগে শুধু বিডিংয়ের অনুমোদন পেতে, তাহলে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ থাকবে না।

কারণ ততদিনে ব্যবসার ধরনই পরিবর্তন হয়ে যায়। যে ধরনের মেশিন আমদানি করার কথা, তার মডেল পরিবর্তন হয়ে যায়। আরও আধুনিক মডেলের মেশিন চলে আসে। আইপিওগুলো দ্রæত পাস করার নিয়ম করতে হবে। দেখেন, ২০০৭ সালে যেখানে ১৭-১৮টি আইপিও এসেছে, বর্তমানে সেখানে ৮-১০টি আইপিও আসছে। অথচ ১০ বছর পর সেটি হওয়ার কথা ছিল অন্তত ৫০টি। একদল মানুষ আছে যারা বুঝে না বুঝে আইপিওর বিরুদ্ধে বলে। বলতে হবে, ভালো আইপিও চাই।

অন্যদিকে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করের হার কমাতে হবে। কারণ একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির সবকিছু স্বচ্ছ। তার কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ কম। তাহলে তাকে তো ওই সুবিধাটা দিতে হবে। আর তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার কমলে, তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির সঙ্গে করের ব্যবধান বেড়ে গেলে, কর সুবিধা নেওয়ার জন্য ভালো কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসবে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে যেহেতু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা তুলনামূলক বেশি, তাই কর হার কম হলেও এসব কোম্পানি থেকে বেশি রাজস্ব পাওয়া যায়।

দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ: বিনিয়োগকারীরা বলছেন বাজারে ভালো ইস্যু আসছে না? ভালো ইস্যু আনার জন্য আপনার প্রতিষ্ঠান কী করবে?

নূর আহমেদ : পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানি আসছে না এমন কথার সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করতে পারছি না। তবে সব কোম্পানি যে ভালো সেটিও বলছি না। পুঁজিবাজারের গভীরতা বাড়াতে হলে বেশি বেশি কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে হবে। যত বেশি কোম্পানি বাজারে আসবে, বাজার ততো বড় হবে। বাজারে যাতে ভালো কিছু কোম্পানি নিয়ে আসতে পারি সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি। আর এটি করতে পারলেই মার্চেন্ট ব্যাংকে কাজ করার বিষয়টি সার্থকতা পাবে।

দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ: একটি পারিবারিক কোম্পানি ভালো ব্যবসা করছে। তারপরও কেন তারা পুঁজিবাজারে আসবে?

নূর আহমেদ : বেশকিছু কারণে একটি কোম্পানির পুঁজিবাজারে আসা প্রয়োজন। প্রথমত, পুঁজিবাজার হচ্ছে শিল্পায়নের পুঁজি জোগানোর জন্য একটি সাশ্রয়ী উৎস। একটি কোম্পানি চাইলে পুঁজিবাজারকে কাজে লাগিয়ে অনেক বড়ো করতে পারবে। অর্থনীতিতে আরও বেশি অবদান রাখতে তারা পুঁজিবাজারে আসতে পারে। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে কোম্পানিগুলো শত বছর টিকে থাকতে পারবে। প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তার মৃত্যুর পর ওই কোম্পানির অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে পড়বে না।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে কোম্পানির করপোরেট কালচার আরও ভালো হয়। বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হয়। মূল উদ্যোক্তার মৃত্যু হলে শেয়ারহোল্ডাররা নতুন নেতৃত্ব বেছে নিতে পারেন, যিনি ওই কোম্পানির হাল ধরেন সেটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে কিন্তু এমন অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে শত বছরের বেশি পুরোনো অনেক কোম্পানি রয়েছে। এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি যেকোনো কোম্পানির ব্র্যান্ড ভ্যালু আরও বাড়িয়ে দেয়।