busজয়নাল আবেদিন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: রাজধানীতে চুক্তিতে গাড়ি (লোকাল বাস) চালানোর কারণেই চালকরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এছাড়া এই চালকদের অনেকেরই নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স। অনেক সময় চালকের পরিবর্তে বাস চালায় হেলপার। এরা কেউ আইনের তোয়াক্কা করে না। লোকাল বাসের এ মরণ রেসের কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।

১৩টি পয়েন্টেই তীব্র প্রতিযোগিতা বেশি দেখা যায়। এই চালকদের কাছে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোও অসহায়। এমন তথ্য জানিয়েছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের একাধিক নেতা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চালকদের নিয়মের মধ্যে আনার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা রয়েছে যা পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব না। এ জন্য পরিবহন মালিক, শ্রমিকদের পাশাপাশি যাত্রীদের সচেতন হতে হবে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, রাজধানীর ২৭৯টি রুটে যাত্রীবাহী বাস মিনিবাসের সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার।

পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিরা জানিয়েছেন, বেতনভুক্ত চালক দিয়ে লোকাল (বাস) গাড়ি চালালে মালিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে নগরীর অধিকাংশ পরিবহন মালিক তাদের বাস মিনিবাস চালককে চুক্তিতে চালাতে দিচ্ছে। চুক্তির কারণেই চালকরা বেপরোয়া। কারণ একই রুটের যে বাস আগে শেষ গন্তব্যে পৌঁছাবে সেই ফিরতি ট্রিপের সিরিয়াল পাবে আগে। এ কারণে একই রুটের বাসের মধ্যেই ভয়াবহ মরণ রেস দেখা যায়। আর এ প্রতিযোগিতার কারণেই এ রেসের পরিণতি হয় দুর্ঘটনা।

এদিকে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলেছে সড়ক দুর্ঘটনা। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না সড়কে মৃত্যুর মিছিল। পথে বেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো তো দূরের কথা, বাড়ি ফেরারই যেন নেই কোনো নিশ্চয়তা। দেশে প্রতিদিনই গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মরছে মানুষ, পঙ্গুত্ব বরণ করছেন কেউ কেউ। সড়ক দুর্ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তায় এখন মস্ত বড় দানবের ভ‚মিকায় কিছু অদক্ষ ও বেপরোয়া গাড়িচালক।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রভাব শুধু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ওপরই নয়, সমাজজীবনেও পড়ছে। প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষের এই অকাল প্রাণহানি ও পঙ্গুত্ব বরণের প্রভাব দেশের অর্থনীতিতেও পড়ছে। এ কারণে সড়ক দুর্ঘটনার হার কমাতে অতি দ্রæত বাস্তবমুখী ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার পাশাপাশি সড়কে মৃত্যুর হার কমাতে জনসচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একের পর এক অকালমৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যক্ষই করতে হচ্ছে না, এ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যা কারোরই কাম্য নয়। সড়ক দুর্ঘটনার মূল অনুষঙ্গ গাড়ির বেপরোয়া গতি।
বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) দেওয়া তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৯০০ জন।

গবেষণায় দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশের সড়কে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬৭৪টি। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ৮৯১ জন, আহত হয়েছে এক হাজার ৭১০ জন। আর ২০১৭ সালে দুই হাজার ৬৫টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন তিন হাজার ৩৯৩ জন। এতে আহত হয়েছে প্রায় ৭ হাজার। সেই হিসাবে এ বছর দুর্ঘটনা বেড়েছে ২ শতাংশ। মৃত্যুর হার বেড়েছে ৬ শতাংশ। দুর্ঘটনা নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান এআরআই বলেছে, চালকের অদক্ষতা, অসচেতনতা আর যথাযথ মনিটরিং-এর অভাবেই নিয়মিত ঘটছে এসব দুর্ঘটনা।

এআরআই-এর সহকারী অধ্যাপক সাইফুল নেওয়াজ বলেন, কোনো চালক পরীক্ষা ছাড়া যেন লাইসেন্স না পায় সে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। একইসঙ্গে টেকনোলজি স্পিড ক্যামেরা বসাতে হবে। পাশাপাশি পরিস্থিতির উত্তরণে হাইওয়ে ও ট্রাফিক পুলিশের দক্ষতা বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ সালেহ উদ্দিন বলেন, প্রত্যেকটি দেশে হাইওয়ের জন্য স্পেশাল পুলিশ অফিসার থাকে। তাদের ট্রেনিং প্রাপ্ত হতে হবে, সেই সঙ্গে প্রযুক্তি দিয়ে তাদের সজ্জিত করতে হবে, যাতে করে অনেক দূর থেকে তারা হাইওয়ে কন্ট্রোল করতে পারেন। সড়কে দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ওভারটেকিং, ওভারলোড ও ওভারস্পিডকেই (থ্রি-ও) দায়ী করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান এআরআই।

এদিকে, গত মাসে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দুই বাসের চাপায় পড়ে কলেজছাত্র রাজীবের মৃত্যুর সপ্তাহ না পেরুতেই নিউমার্কেটে শিশুসহ দুর্ঘটনার শিকার হন আয়েশা আক্তার। কাছাকাছি সময়ের মধ্যে ঢাকার বাইরের এ ধরনের আরেকটি ঘটনা হতবাক করেছে দেশবাসীকে। ময়মনসিংহে অটোরিকশা থেকে ছিটকে পড়া এক নারীকে পিষ্ট করে দেয় বাসের চাকা। দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার পরও বাসচালকদের বেপরোয়া গতিকে থামানো যায়নি।

এখনো তারা আগের মতো বেপরোয়া গতিতেই গাড়ি চালাচ্ছেন। বেপরোয়া চালনায় নিয়মিত হতাহতের ঘটনা ঘটলেও বিকার নেই বাসচালকদের, এর জন্য মালিকের বেঁধে দেওয়া জমার টাকা উঠানোর তাগাদাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন চালকরা। যাদের জমা নির্দিষ্ট করা নেই তাদের কেউ বেশি ভাড়া উঠিয়ে নিজের ভাগের অঙ্ক বড় করা, আবার কেউ মালিককে সন্তুষ্ট করতে রাস্তায় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন।

বাসচালকদের ভাষ্য মতে, রাজধানীর বেশিরভাগ রুটের বাসের জমার টাকা মালিকরা নির্ধারণ করে দেন। আবার কিছু পরিবহন তাদের আয় হিসাব করে মোট যাত্রী পরিবহনের ওপর (পথে চেকারদের দেওয়া হিসাব-ওয়ে বিল)। সেখানেও যাত্রী বেশি তোলার জন্য মালিকপক্ষের চাপ থাকে। প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে এক বাসের সঙ্গে আরেক বাসের ঠোকাঠুকি, সংঘর্ষ নিত্যদিনের ঘটনা। এ কারণে বেশিরভাগ পরিবহনের বাসের গায়ের রং চটে গেছে।

খুলে গেছে বাম্পার, সংকেত বাতি। প্রায়ই ভাঙছে ভিউ মিরর। অন্যদিকে, মালিকরা দূষছেন চালকদের। তারা বলছেন, ভালো চালকের যেমন অভাব রয়েছে, পাশাপাশি চালকদের মাদকাসক্তিও দুর্ঘটনার কারণ। গত এপ্রিলে কারওয়ান বাজারে দুই বাসের পাল্লার মধ্যে পড়ে বাম হাত হারান তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এভাবে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে রাজীবের মৃত্যু তুমুল আলোচনার জন্ম দিলেও তার কোনো প্রভাব নেই চালকদের মধ্যে।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ পরিবহন খাতে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতাদের দাপটে দোষী চালকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া প্রায় অসম্ভব। প্রতিবছর দুর্ঘটনার সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি নিহতের সংখ্যাও বাড়ছে।

তবে ভয়াবহ খবর হলো, মিডিয়ায় প্রকাশের বাইরেও থেকে যায় আরো সড়ক দুর্ঘটনার খবর। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মামলা হয়, রায়ও হয়, তবে সেগুলো ভুক্তভোগীর কাছে পৌঁছানো নিয়ে সংশয় থেকে যায়। ক্ষতিপূরণ পাওয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার। সড়কে প্রাণহানি ও শৃঙ্খলা ফেরাতে দরকার ইতিবাচক চিন্তা ও সমন্বিত পদক্ষেপ। সড়কপথে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হলে দুর্ঘটনার হার কমে আসবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে নিহতের সংখ্যা ১২ হাজার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ২১ হাজার। সরকারি হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর প্রাণহানির সংখ্যা আড়াই থেকে তিন হাজার। এআরআই বলেছে, দুর্ঘটনার সঠিক তথ্য তুলে আনতে সুনির্দিষ্ট কোনো সংস্থা নেই। তাই সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না।

পুলিশ রিপোর্টের ওপর সরকারি হিসাব করা হয়। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪ সালে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৬৫৮২ জন, ২০১৫ সালে ৫০০৩ জন ২০১৬ সালে ৪১৪৪ জন আর গত বছর ৪২৮৪ জন নিহত হয়। প্রতিবছর দুর্ঘটনার সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি নিহতের সংখ্যাও বাড়ছে। সড়ক দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণে সরকারিভাবে একটি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

অর্থোপেডিক হাসপাতালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাদের রোগীর ৫৬ শতাংশই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার। অন্য হাসপাতালগুলোতে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশই সড়ক দুর্ঘটনা কবলিত রোগী থাকেন। এআরআই বলেছে, দেশের মহাসড়কগুলোতে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। যার মধ্যে ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে অনিয়ন্ত্রিত গতিতে যান চালনায়। চালকদের বেপরোয়া ঝুঁকিপূর্ণ যানচালনার জন্য ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়।

অন্যান্য কারণে দুর্ঘটনার হার ১০ শতাংশ। দৈনিক ১৫ থেকে ১৮ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। তাদের মতে, সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে প্রতি বছর প্রায় সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়, যা মোট জিডিপির শতকরা ১ দশমিক ৫ ভাগ।

বড় অপরাধে ছোট শাস্তি : নিরাপদ সড়কের দাবিতে দীর্ঘদিন থেকে দেশে আন্দোলন চলছে। আন্দোলনকারীরা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তির শাস্তি সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন ও সর্বনিম্ন ৫ থেকে ৭ বছরের জেল ও জামিন অযোগ্য ধারার বিধান রেখে আইন করার দাবি করে আসছেন।

সড়ক পরিবহন আইনের যে খসড়া তৈরি করা হয়েছে, তাতে বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ও জান-মালের ক্ষতি হলে চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি মাত্র ৩ বছরের জেল অথবা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

সবচেয়ে বড় কথা, দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তি দেওয়া হবে, সে ব্যাপারে কোনো ধারা স্পষ্ট করা হয়নি। বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে খসড়ায় ৩ বছরের শাস্তির বিধানটাও মালিক ও শ্রমিক নেতাদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তারা এই স্বল্প সাজায়ও সন্তুষ্ট নন, তৎপরতা চালাচ্ছেন তা আরো কমিয়ে আনার।