gazipurদেশ প্রতিক্ষণ, গাজীপুর: গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়া নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। ভোটের মাত্র ৯ দিন আগে গত রোববার হাইকোর্ট তিন মাসের জন্য এই নির্বাচন স্থগিত করেন। এ নিয়ে দেখা দিয়েছে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত। স্থানীয় সরকার রাজনীতি থেকে শুরু করে বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছে জাতীয় রাজনীতিতেও। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে এই ঘটনা ঘটায় বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে বেশি।

এ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে বড় দুই রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী বিএনপি। স্থগিতের পরপরই বিএনপি অভিযোগ করেছে, পরাজয় আঁচ করে সরকারই ষড়যন্ত্র করে এই নির্বাচনটি আটকে দিয়েছে। এমনকি এর মধ্য দিয়ে দলের বিপুল বিজয় ও সরকারের পরাজয় হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, গাজীপুরে বিএনপির প্রার্থী বিপুল ভোটে বিজয়ী হতো। কিন্তু সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রম ও জনশক্তিবিষয়ক সম্পাদক এ বি এম আজাহারুল ইসলাম সুরুজকে দিয়ে রিট করিয়ে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে।

পক্ষান্তরে বিএনপির এমন অভিযোগ নাকচ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলেছে, আদালতের এই সিদ্ধান্তে সরকারের কোনো হাত নেই। এ ব্যাপারে গত রোববার দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, সীমানাসংক্রান্ত জটিলতার কারণে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন স্থগিত হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের কিছুই করার নেই। তিনি আরো বলেছেন, আদালত স্বাধীন।

আদালত যেকোনো জায়গায় যেকোনো কিছুর ওপর রায় দিতে পারেন। আদালত সরকারের বিরুদ্ধেও রায় দিয়েছেন। তিনি এমনও বলেন, পূর্ণ শক্তি নিয়েই গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রচার কার্যক্রমে ব্যস্ত ছিল আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারেও প্রচন্ড আশাবাদী ছিলেন দলের নেতাকর্মীরা।

আলোচনায় আসছে ইসিও। আদালতের নির্দেশনা হাতে পাওয়ার পর সংস্থাটি পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি জানান, কোন পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত এ নির্দেশনা দিয়েছেন তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই কর্মকর্তা বলেন, আদালত সব কিছু পর্যবেক্ষণ করেই নির্দেশনা দেন।

তবে রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদ এ দুইটি নির্বাচন ইসির মূল দায়িত্ব। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর ক্ষেত্রে ইসি শুধু নির্বাচন পরিচালনা করে। নির্বাচনী বিষয় ছাড়া অন্য কোনো জটিলতা থাকলে তা নিরসন করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ। কথা বলছেন নির্বাচন বিশ্লেষক ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরাও।

কেন ও কাদের গাফিলতিতে নির্বাচন স্থগিত হলো, শিগগির এই সিটিতে নির্বাচনের সম্ভাবনা রয়েছে কিনা, স্থগিতের ফলে এই সিটি কর্মকান্ড কীভাবে চলবে, এমনকি খুলনাসহ আসন্ন রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটির নির্বাচনকে ঘিরেও এমন কোনো জটিলতা দেখা দিতে পারে কিনাÑ জনমনে এমন নানা প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।

বিশ্লেষকরা এই স্থগিতকে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় বড় ক্ষতি হিসেবে দেখছেন। এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বেশি ক্ষতি স্থানীয় নাগরিকদের। কারণ প্রশাসন নিয়ে চালানো করপোরেশন আদতে তেমন কোনো কাজ করতে পারে না। উন্নয়ন কর্মকান্ড থেমে যায়। নাগরিকদের দুর্ভোগ বাড়ে। ছোটোখাটো কাজ হয়তো করা যায়। কিন্তু বড় প্রকল্প বা চলমান প্রকল্প অব্যাহত রাখতে হলে নির্বাচিত প্রতিনিধি দরকার। সরকার মনোনীত প্রশাসন আইনি জটিলতায় পড়ে। কাজ করতে পারে না।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এখানে কোনো মেয়র না থাকায় কর্মকা- থেমে গেছে। ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে প্যানেল মেয়র কাক্সিক্ষত কাজ করতে পারছেন না। নগরীতে নানা দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। তার মতে, ইসির উচিত সব জটিলতা নিরসন করে নির্বাচন নিশ্চিত করা। এজন্য তাদের সর্বশক্তি দিয়ে আইনি লড়াইয়ে যাওয়া উচিত।

জানা গেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনে সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়নের ছয়টি মৌজা অন্তর্ভুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ বি এম আজহারুল ইসলাম সুরুজের এক রিট আবেদনে গত রোববার আদালত এই সিটির নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিতাদেশ দেন। তফসিল অনুযায়ী আগামী ১৫ মে গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এখন গাজীপুরের নির্বাচন আটকে গেল।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠিত হওয়ার পর এটি দ্বিতীয় নির্বাচন; ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে বিএনপি নেতা এম এ মান্নান মেয়র হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের আজমত উল্লাহ খানকে হারিয়ে। এবার বিএনপি প্রার্থী বদল করে মনোনয়ন দেয় টঙ্গী পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান হাসানউদ্দিন সরকারকে; ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও প্রার্থী বদলে আনে জাহাঙ্গীর আলমকে। জয়ের আশা নিয়ে দুই পক্ষের নির্বাচণী প্রচারণায় উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল এই সিটি।

গাজীপুর সিটির নির্বাচন স্থগিত হলেও ঘটনাটি বেশি আলোচিত হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ঘুরেফিরে আসছে নির্বাচনী রাজনীতিতে। বিএনপি এর জন্য সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দায়ী করলেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।

বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে এই খুলনা ও গাজীপুর সিটির নির্বাচনের দিকে নজর ছিল সবার। এ নির্বাচনের ফলের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনেও পড়তে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। এ নির্বাচনের ব্যাপারে ভীষণ তৎপর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।

সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে ছিলেন দলের নেতারা। এমনকি দুই দলই প্রার্থী বাছাইয়ে মাঠের জনপ্রিয়তাকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ফলে খুলনার মতো গাজীপুর সিটির নির্বাচনও দুই দলের জন্যই ছিল চ্যালেঞ্জ। এর আগে গত জানুয়ারিতে তফসিল ঘোষণার পর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন এবং উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নতুন ওয়ার্ডগুলোর নির্বাচন আদালতের নির্দেশনায় স্থগিত হয়েছিল।

নির্বাচন স্থগিতের ঘটনা কীভাবে দেখছে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, নির্বাচন স্থগিতাদেশ একেবারেই আদালতের বিষয় বলে মনে করছে দল। গত রোববার দুপুরে আদালতের স্থগিতাদেশের পর গাজীপুর সিটির নির্বাচনে দলের মেয়র পদপ্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম গণভবনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ ব্যাপারে কী কথা হয়েছে তা জানা যায়নি। তবে সূত্রগুলো বলছে, দলের এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বিষয়টি স্থানীয় সরকার ও আদালতের, ফলে এটি তারাই সুরাহা করবে। এখানে আওয়ামী লীগের কিছু করার নেই। নিয়ম অনুযায়ী যা হওয়ার, তাই হোক।

এ ব্যাপারে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, গাজীপুরে নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে বিএনপি প্রার্থীর কোনো অবস্থানই তৈরি হয়নি। সুতরাং আওয়ামী লীগের নির্বাচন বন্ধ করার প্রশ্নই ওঠে না। এই মামলাটি (রিট) পুরনো, ২০১৫ সালে করা। গত রোববার শুনানি শেষে উচ্চ আদালত নির্বাচন স্থগিতের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

অন্যদিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত করে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেছেন বিএনপির প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকার। গতকাল সোমবার আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর অনুমতি নিয়ে তিনি আবেদন করেন। পরে সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ওই আবেদন জমা দিলেও কপি আদালতে না আসায় সোমবার বিকাল পর্যন্ত চেম্বার আদালতে শুনানি হয়নি বলে তার আইনজীবী সানজিত সিদ্দিকী জানান। দলের মতে, জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার এসব নির্বাচনে পরাজয় দেখতে চায় না বলেই একের পর এক নির্বাচন স্থগিত করছে।

নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাওয়ায় গাজীপুর সিটি করপোরেশন কীভাবে চলবে? জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন বলেন, যে তিন মাসের জন্য নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে, সে তিন মাস এখন যেভাবে চলছে সেভাবেই চলবে। সেক্ষেত্রে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকে প্যানেল মেয়র মনোনীত করা হবে। তিনিই চালাবেন।

প্রথম প্যানেল মেয়র না পাওয়া গেলে দ্বিতীয় প্যানেল মেয়র, দ্বিতীয় প্যানেল মেয়র না পাওয়া গেলে তৃতীয় প্যানেল মেয়র করপোরেশনের দায়িত্ব পাবেন। এর বাইরে স্থানীয় মন্ত্রণালয় থেকে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত আসতেও পারে। তারা প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারে। কারণ বিষয়টি স্থানীয় মন্ত্রণালয়ের। তবে নির্বাচন হতে হবে-সেটাই মূল পথ।