bifc lagoদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নানা অনিয়মের কারণে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বিআইএফসি মোট বিতরণ করা ঋণের ৯৩ শতাংশই বর্তমানে খেলাপি হয়ে পড়েছে। এ খেলাপি ঋণের সিংহভাগই রয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে। কয়েকবার প্রতিশ্রæতি দিয়েও এসব ঋণ পরিশোধ করেননি তিনি।

স¤প্রতি বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে নিরীক্ষক। সঞ্চিতি ঘাটতি, বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ, ঋণ প্রদানে অস্বচ্ছতা, সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণে ব্যর্থতাসহ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে নিরীক্ষক আহমেদ জাকির অ্যান্ড কোম্পানি।

বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) ঋণ বিতরণে অনিয়মের কারণে ডুবতে বসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে বিআইএফসির বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৯১ কোটি টাকাই খেলাপী। প্রতিষ্ঠানটির ঋণের ৯৩ শতাংশই খেলাপী হয়ে পড়েছে।

২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের মালিকানাধীন সানম্যান গ্রæপের ৩৪ কোম্পানির নামে-বেনামে বিআইএফসি থেকে ৭০৩ কোটি টাকা বের করে নেয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে। এর মধ্যে ২৭ প্রতিষ্ঠানের নামে ৫৭০ কোটি টাকা সরাসরি নেয়া হয়। একই গ্রæপের সাত প্রতিষ্ঠানকে গ্যারান্টার দেখিয়ে নেয়া হয় আরও ১৩৩ কোটি টাকা।

খেলাপী হওয়ার পরও কিছু ঋণ হিসাবকে নিয়মিত দেখানো ও সিআইবিতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অনেক ঋণ হিসাবের রিপোর্ট না করার মতো বিষয়ও ধরা পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে।

ঋণ জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ার পর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম মান্নান ও মেয়ে তানজিলা মান্নানকে অপসারণের পাশাপাশি বিআইএফসিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই সঙ্গে আত্মসাতকৃত অর্থ আদায়ে আইনী পদক্ষেপ নিতে বিআইএফসিকে নির্দেশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে মেজর (অব.) মান্নান আত্মসাতকৃত অর্থের মধ্যে ২০০ কোটি টাকা ফেরতের প্রতিশ্রæতি দেন। যদিও এখন পর্যন্ত ফেরত দিয়েছেন ১২০ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে বিআইএফসির পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়। ২০১৬ সালের মার্চে পর্ষদে পাইওনিয়ার ড্রেসের প্রতিনিধি লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোল্লা ফজলে আকবর ও সাকিব আজিজ চৌধুরী যোগ দেন। তাছাড়া পর্ষদে আগে থেকেই মেজর (অব.) মান্নানের মেয়ে তাজরিনা মান্নান পরিচালক হিসেবে ছিলেন। এ সময় স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে মোঃ এনায়েত উল্লাহ ও ড. মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান যোগ দেন।

একই বছরের জুনে ফাইভ কন্টিনেন্টস ক্রেডিট লিমিটেডের প্রতিনিধি হিসেবে বদরুন্নেসা ও তিস মার্ট ইনকর্পোরেশনের প্রতিনিধি হিসেবে জেবুন্নেসা আকবর পর্ষদে আসেন। তবে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরেই লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোল্লা ফজলে আকবর, সাকিব আজিজ চৌধুরী, ড. মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান, বদরুন্নেসা ও জেবুন্নেসা আকবর পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করেন।

আর্থিক খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান বা স্প্রেড কমে যাওয়া, কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম-দুর্নীতি বৃদ্ধি পাওয়া, প্রত্যাশা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করতে না পারা এবং শেয়ারবাজারে দুর্বল পারফরম্যান্সের কারণেই এনবিএফআই খাতে দুর্বলতা বেড়েছে।

তবে গ্রিন জোনে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা ও আর্থিক সক্ষমতা দুটোই বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি তিন মাস পর দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট তৈরি করে।

ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা উদ্বেগের কারণ থাকলেও তা এখনো হতাশাজনক অবস্থানে যায়নি বলে মনে করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বিএলএফসিএর চেয়ারম্যান ও ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খলিলুর রহমান।

যাচাই-বাছাই করে নিয়ন্ত্রিত ঋণ বিতরণের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ অনেক কমে গেছে। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফা কমার পেছনে স্প্রেড কমে যাওয়াটাও ভ‚মিকা রেখেছে। কিছু প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত জালিয়াতি ও কেলেঙ্কারির ঘটনাও এনবিএফআই খাতকে পিছিয়ে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

এর মধ্যে বিআইএফসি অবস্থায় খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ফলে এ কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারা কোম্পানির ভবিষ্যক নিয়ে শঙ্কায়। বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় মেজর (অব.) মান্নানের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে মামলা করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে গ্রেফতার এড়াতে উচ্চ আদালত থেকে দুই মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নিয়েছেন তিনি।

জামিনে থাকা অবস্থায়ও এ ব্যবসায়ীকে সিআইডি একবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকেও স¤প্রতি বিআইএফসির কাছে ঋণসংক্রান্ত বিভিন্ন নথি তলব করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে বিআইএফসির বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৯১ কোটি টাকাই খেলাপি। বিআইএফসির নিরীক্ষকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, মেজর (অব.) মান্নানের মালিকানাধীন সানম্যান গ্রæপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণের পরিমাণ ৬২৩ কোটি টাকা, যার পুরোটাই খেলাপি।

এছাড়া বিশ্বাস গ্রæপের কাছেও ২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে বিআইএফসির। প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ৩৮ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণকে মূল সমস্যা হিসেবে দেখছেন বিআইএফসির বর্তমান চেয়ারম্যান রুহুল আমিন। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মেজর (অব.) আবদুল মান্নান বেআইনিভাবে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার দায় বহন করতে হচ্ছে বিআইএফসিকে। নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও তার কাছ থেকে টাকা আদায় করা যাচ্ছে না।

এখনো বিআইএফসিতে নামে-বেনামে মেজর (অব.) মান্নানের ৬০ শতাংশের বেশি শেয়ার রয়েছে। এ কারণে নতুন করে কেউ শেয়ার কিনতে পারছেন না। তিনি টাকাও দিচ্ছেন না আবার মালিকানাও ধরে রাখছেন। আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে কিছু পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছি। মেজর (অব.) মান্নানের শেয়ার অবলুপ্ত করার বিষয়টিও রয়েছে তাতে।

২০০৬ সালে তালিকাভুক্ত বিআইএফসির অনুমোদিত মূলধন ৪০০ কোটি ও পরিশোধিত মূলধন ১০০ কোটি ৬৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা। মোট শেয়ারের ৩৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের কাছে, ৪৮ দশমিক ৮২ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও বাকি ১৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিআইএফসির সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) এম এ মান্নান, তাঁর পরিবারের সদস্য পরিচালক এবং তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি পরিচালকরা বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণের আড়ালে ৪৮টি হিসাবের মাধ্যমে কোম্পানিটি থেকে ৫১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।

এখন এই মুহূর্তে প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী সম্পদ, ঋণ আর দায় পরিস্থিতি সব মিলিয়ে এমন নাজুক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিআইএফসির টার্মিনেশন (অবসায়ন) ছাড়া আর কোনো পথ দেখছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রতিষ্ঠানের সাবেক চেয়ারম্যানের (এম এ মান্নান) নামে-বেনামে ঋণ নেওয়ার সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিআইএফসির এমডি এম এম মোস্তফা বিলাল বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেহেতু বলেছে, তারা ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগারের ভিত্তিতেই বলেছে। এ ছাড়া চেয়ারম্যানের ঋণ নেওয়ার বিষয়টি কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনেও রয়েছে বলে জানান তিনি। মেজর (অব.) এম এ মান্নানের সঙ্গে কথা বলার জন্য গত সোমবার যোগাযোগ করা হলে তাঁর একান্ত সচিব (পিএস) জানান, স্যার তো দেশের বাইরে।

যে হাল হয়েছে বিআইএফসির : গত ডিসেম্বর (২০১৭) পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, বিআইএফসির মোট সম্পদের পরিমাণ ৯৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ঋণ বা লিজ দিয়েছে ৮৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৯৭ কোটি টাকাই শ্রেণিকৃত বা খেলাপি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যার মধ্যে ৭৭০ কোটি টাকাই মন্দমানের শ্রেণিকৃত ঋণ, যা ফিরে পাওয়ার আশা খুবই কম। খেলাপি ঋণ ও লিজ বাদে কোম্পানিটির প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ মাত্র ১৭০ কোটি টাকা।

অথচ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কর্জ হিসেবে ও সাধারণ আমানতকারীদের কাছ থেকে আমানত হিসেবে প্রায় ৮০৮ কোটি টাকার দায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। প্রকৃত সম্পদের তুলনায় দায় কয়েকগুণ বেশি। জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির পুঞ্জীভ‚ত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া কোম্পানির তথ্য অনুযায়ী প্রতিমাসে প্রায় ৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা নিট ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটির দায়ও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব দায় আরও বেড়ে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আমানতকারীদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। এতে করে সামান্য হলেও সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী বলেন, বিআইএফসির সবলতা ও দুর্বলতার বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আপাতত এটুকুই বলা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে আর কিছু বলার নেই। প্রতিষ্ঠানটির এই পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে সরকারও।

কীভাবে বিআইএফসির আর্থিক অবস্থা এত খারাপ হয়ে গেল, এই ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী ভ‚মিকা নিয়েছে, সেসব বিষয়ে জানতে চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব ইউনুসুর রহমান বলেন, বিআইএফসিতে প্রকৃত অর্থে কী ঘটেছে আমরা তা জানতে চেয়েছি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। কারণ গুরুতর যেসব অনিয়ম ঘটেছে, তা হঠাৎ একদিনে ঘটেনি।

সে পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভ‚মিকা কী ছিল, সেটিও জানা দরকার। এ বিষয়ে তাদের (বাংলাদেশ ব্যাংক) মতামত পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

কী হবে আমানতকারীদের : বিআইএফসিতে যারা আমানত করেছেন বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের আমানত ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী গত বছরের জুন পর্যন্ত হিসেবে বিআইএফসির কাছে ২১টি ব্যাংক ও ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানত ও কর্জ হিসেবে পাওনা প্রায় ৫৭৪ কোটি টাকা, যা এরই মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে ১ হাজার ৩৬ জন ব্যক্তি আমানতকারীর আমানতের পরিমাণ প্রায় ২১৪ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কোনো ব্যাংক অবসায়ন হয়ে গেলে, আমানত বীমা তহবিল হতে প্রতিটি হিসাবের বিপরীতে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে প্রতিষ্ঠানটির এখন যে অবস্থা তাতে এই মুহূর্তে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
যেভাবে অনিয়মের শুরু : জানা গেছে, ১৯৯৮ সালের ১৯ ফেব্রæয়ারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিআইএফসিকে লাইসেন্স দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গুরুতর কোনো অনিয়ম খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর থেকেই বদলে যেতে থাকে পরিস্থিতি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসন্ধানে একের পর এক ঋণ অনিয়ম বেরিয়ে আসতে থাকে। ২০১৫ সালের ২৪ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন মহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে প্রতিষ্ঠানটিতে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অপসারণ করা হয় দুই পরিচালককে। ঋণ খেলাপির দায়ে আরও ৩ পরিচালক অপসারিত হন। পরে পদত্যাগ করেন আরও এক পরিচালক। তবে এতসব উদ্যোগের মধ্যেও অনিয়মের পাগলা ঘোড়াকে দাবিয়ে রাখতে না পেরে শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক বিআইএফসির তখনকার পর্ষদ চেয়ারম্যান, পরিচালক, স্বতন্ত্র পরিচালক ও ঋণ অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কোম্পানিটির এমডিকে নির্দেশ দেয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, ২০১৫ সালের ১৭ নভেম্বর দেওয়া এক চিঠিতে কোম্পানির তখনকার পর্ষদ চেয়ারম্যান, পরিচালক, স্বতন্ত্র পরিচালক ও জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিআইএফসির এমডিকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওই বছরের ডিসেম্বরে মেজর (অব.) এম এ মান্নান, তাঁর পরিবারের সদস্য পরিচালক, স্বতন্ত্র পরিচালক ও তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পরিচালকগণ কর্তৃক ঋণের আড়ালে অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-কেও চিঠি দেওয়া হয়। একই সময়ে কোম্পানিটি থেকে আত্মসাৎকৃত অর্থ সন্ত্রাস বা অন্য কোনো অপরাধে ব্যয় হয়েছে কি না তা অনুসন্ধান ও অধিকতর তদন্তে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সিআইডিকে চিঠি দেওয়া হয়। এ ছাড়া অনিয়মের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা আহমেদ করীম চৌধুরী দেশ ছেড়ে কানাডা পাড়ি দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, তার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর মাধ্যমে কানাডার ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (ফিনট্র্যাক) অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে এসব চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো থেকে অগ্রগতি প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো পায়নি বলে জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অবসায়ন ছাড়া পথ নেই : প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ কী হবে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের সমন্বয়ে গঠিত ‘সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট টিম’ গত ২৯ নভেম্বর একটি সভা করে। ওই সভায় বেশ কয়েকটি বিকল্প নিয়ে আলোচনা হলেও শেষে প্রতিষ্ঠানটির অবসায়নের (টার্মিনেশন) পক্ষেই মত দেন সংখ্যাগরিষ্ঠরা।

প্রথমে কোম্পানিটিতে প্রশাসক বসানোর প্রস্তাব আসলে সভায় বলা হয় এমন একটি নাজুক আর্থিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটিতে প্রশাসক নিয়োগেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত কোম্পানিটির কার্যক্রমের ওপর সাময়িক স্থগিতাদেশের প্রস্তাবে বলা হয়Ñহঠাৎ করে একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ঘোষণা করা হলে বাজারে গুজবের মাধ্যমে সমগ্র আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তৃতীয় প্রস্তাবে কোম্পানিটিকে পুনঃগঠন ও একত্রীকরণের বিষয়ে আলোচনা উপস্থাপন করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট জানায়, প্রকৃত সম্পদের তুলনায় কোম্পানিটির দায় কয়েকগুণ বেশি হওয়ায় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান একীভ‚তকরণে (মার্জার) আগ্রহী হবে না বলে ধারণা করা যায়। এ ছাড়া কোম্পানিটির মোট ঋণ বা লিজের ৮৫ শতাংশ মেজর (অব.) এম এ মান্নানের হওয়ায় এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মিলিয়ে বিআইএফসির ৬০ শতাংশ শেয়ারের ওপর মেজর মান্নানের কর্তৃত্ব থাকায় বাস্তব প্রেক্ষাপটে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একে মার্জার বা একীভ‚তকরণ প্রক্রিয়া সম্ভব হবে না বলেই সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট জানায়। শেষে বিআইএফসির অবসায়ন শুরু করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট। বিআইএফসির মতো একটি প্রতিষ্ঠান অবসায়ন করা হলে দেশের অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে সে বিষয়েও মতামত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, বিআইএফসির মোট দায় প্রায় ১০ বিলিয়ন টাকা, যা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের মোট দায়ের (প্রায় ১২ হাজার ৩৪০ বিলিয়ন টাকা) ০ দশমিক ০৮ শতাংশ। ফলে প্রতিষ্ঠানটিকে অবসায়ন করা হলে আর্থিক খাতে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না বলেই মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমন কি বিআইএফসির অবসায়ন হলে আর্থিক খাতে ভবিষ্যতে আর্থিক শৃঙ্খলার একটি দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ হয়ে থাকবে, যা আর্থিক শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক ভ‚মিকা পালন করবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ে গত সপ্তাহে পাঠানো এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।