AB-Bank1দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের কোম্পানি এবি ব্যাংক বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় অভিযোগ রয়েছে। অব্যবস্থাপনা, সুশাসনের অভাব, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও প্রভিশন ঘাটতিসহ বিভিন্ন কারণে ইতোমধ্যে প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এরপরও থামছে না প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থার অবনতি। দেখা দিয়েছে নগদ অর্থের সঙ্কট। পাশাপাশি কোম্পানিটিতে এ বছর নো ডিভিডেন্ড ঘোষনা দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ, প্রভিশনের চাপ ও তারল্য সংকটের কারণে বেসরকারি খাতে প্রথম প্রজন্মের ব্যাংক এবি ব্যাংকের মুনাফায় ধস নেমেছে।

শ্রেণিকৃত ঋণ ও বাড়তি প্রভিশনের চাপে এক বছরেই ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা কমেছে ৯৭ দশমিক ২৯ শতাংশ। খেলাপি ঋণের পাশিাপাশি ঋণের সুদ ও বিনিয়োগ আয় কমার বিষয়টিও ব্যাংকটির পিছিয়ে পড়াকে ত্বরান্বিত করেছে। মুনাফা আশঙ্কাজনক হারে কমার কারণে এবি ব্যাংক ‘এ’ থেকে ছিটকে ‘জেড’ ক্যাটেগরিতে নেমেছে।

এদিকে ব্যাংকের প্রধান আয়ের ক্ষেত্র ঋণ বিতরণ থেকে প্রাপ্ত সুদ আয়েও নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। কমে গেছে আগের বছরের তুলনায় সুদপ্রাপ্তির পরিমাণ। এমনকি প্রতিষ্ঠানটি সুদ বাবদ যে পরিমাণ আয় করছে, সুদ পরিশোধেও প্রায় সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ক্যাশ ফ্লোতে। ব্যাংকটির ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, একদিকে অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ধারের পরিমাণ বেড়েছে, অন্যদিকে সরকারি খাতে যে বিনিয়োগ ছিল তা কমেছে। এর মানে হলো ব্যাংকটি বড় ধরনের তারল্য সঙ্কটে ভুগছে।

একদিকে তারা উত্তোলন বাড়াচ্ছে, ঋণ বাড়াচ্ছে, অপরদিকে সরকারি সিকিউরিটিজে স্বল্প মেয়াদি যে বিনিয়োগ ছিল, সেটি কমিয়ে আনা হচ্ছে। কারণ তাদের মূল অ্যাসেট লোন অ্যান্ড অ্যাডভান্স’র বড় অংশই সম্ভাবত নন-পারফর্মিং (খেলাপি) হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, সুদপ্রাপ্তি ও সুদ পরিশোধ প্রায় সমান হওয়া ব্যাংকের দুরাবস্থার একটি দিক। এটি ব্যাংকের খারাপ ও দুর্বল সম্পদ ব্যবস্থাপনাই নির্দেশ করে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত আর্থিক বছরে সুদ থেকে এবি ব্যাংকের আয় দাঁড়ায় এক হাজার ৮০৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, যা এর আগের আর্থিক বছরের একই সময়ে ছিল এক হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। সেই হিসেবে এক বছরে সুদ আয় কমেছে ১৩৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এ কারণে প্রকৃত সুদ আয়ও কমেছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা।

অন্যদিকে পুঁজিবাজারে বিরূপ বিনিয়োগ পরিস্থিতি ও তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশের হার কমায় ব্যাংকটির বিনিয়োগ আয়ও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বিনিয়োগ আয় এর আগের আর্থিক বছরের তুলনায় ৩৮ কোটি টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৭২ কোটি ৬১ লাখ টাকায়। প্রকৃত সুদ ও বিনিয়োগ আয় কমায় এক বছরে এবি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমেছে সাড়ে ৩৮ কোটি টাকা। তবে আয় কমলেও ব্যয়ের অঙ্কে তেমন হেরফের হয়নি, এ খাতে প্রায় ৬০২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ব্যাংকটি।

এদিকে পরিচালন আয় কমার বিপরীতে শ্রেণিকৃত ঋণ বৃদ্ধি ও এর বিপরীতে প্রভিশনের চাপ এবি ব্যাংককে চরম দুরবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে এবি ব্যাংকের শ্রেণিকৃত ঋণ পরিমাণ প্রায় সাড়ে এক হাজার ৬২৫ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা এর আগের আর্থিক বছরে প্রায় এক হাজার ১২৪ কোটি টাকা ছিল।

সেই হিসাবে এক বছরেই ব্যাংকটির শ্রেণিকৃত ঋণ ৫০১ কোটি টাকা বেড়েছে। আর ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের প্রায় ৪৩ শতাংশই আট শীর্ষ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়েছে, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। গত এক বছরে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণের পরিমাণ ৬৪ দশমিক ২৮ শতাংশ বেড়েছে।

২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির মোট প্রভিশন দাঁড়িয়েছে ৪৯৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা, যা এর আগের আর্থিক বছরের তুলনায় ১৯৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা বেশি। আর তিনটি খাতের মধ্যে সন্দেহজনক ও মন্দ ঋণের প্রভিশন আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে, যার পরিণতি এবি ব্যাংকের কর-পরবর্তী মুনাফায় বড় ধস নামিয়েছে।

এবি ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মহাদেব সরকার সুমন বলেন, ‘কয়েক বছরে শ্রেণিকৃত ঋণের কারণে ব্যাংকের বড় অঙ্কের অর্থ আটকে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশনের কারণে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। শ্রেণিকৃত ঋণই পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ। চলমান সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য খেলাপি ঋণ আদায়ে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে খেলাপি হয়ে গেলে সেই ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। গ্রাহকরা না চাইলে টাকা ফেরত পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। তার পরও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়টি এখন খেলাপি ঋণ আদায়ের ওপর নির্ভর করছে।’

আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, এবি ব্যাংক সর্বশেষ সমাপ্ত আর্থিক বছরে প্রায় চার কোটি আট লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে, যা এর আগের আর্থিক বছরের একই সময়ে ছিল প্রায় ১৫০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা প্রায় ৯৭ দশমিক ২৯ শতাংশ কমেছে, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় ১৪৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।

মুনাফায় বড় ধরনের ধসের কারণে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়েছে এবি ব্যাংক। অথচ এর আগের বছরেই গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মুনাফা করেছিল ব্যাংকটি। আর ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়ে লভ্যাংশ দেওয়ার সক্ষমতাও হারিয়েছে এবি ব্যাংক। সমাপ্ত আর্থিক বছরে কোনো লভ্যাংশ দিতে না পেরে ‘এ’ ক্যাটেগরি থেকে ‘জেড’ ক্যাটেগরিতে ছিটকে পড়েছে ব্যাংকটি।

উল্লেখ্য, ১৯৮৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় প্রথম প্রজšে§র বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম এবি ব্যাংক। পাঁচ বছর ধরে ব্যাংকটির কর-পরবর্তী মুনাফা শতকোটি টাকার ওপরেই রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ প্রায় ১৫১ কোটি টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছিল।

ঋণের নামে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ, খেলাপি ঋণের বোঝা, প্রভিশনের চাপে সৃষ্ট তারল্য সংকট ও ব্যাংকিং সেক্টরে চলমান অস্থিরতার কারণে ব্যাংকটির মুনাফা এখন তলানিতে। যার প্রভাব পড়েছে শেয়ারদরেও। গত ছয় মাসে এবি ব্যাংকের শেয়ারদর উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।