Good-news-750x400আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: সরকারি খাতের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পরেই এই সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে। এই দফায় সঞ্চয়পত্রের সুদের হার সর্বোচ্চ দুই শতাংশ কমানো হবে। বড় আকারে সুদহার কমানোর পাশাপাশি সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রেও নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। তবে সঞ্চয় পত্রের সুদের হার কমলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন। বিশেষভাবে দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারবাজার ও ব্যাংকমুখী করতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

তবে দেশের পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে হলে দ্রুত সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর বিকল্প নেই বলে মনে করেন অধ্যাপক আবু আহম্মেদ। সঞ্চয়পত্র যাতে কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত না হতে পারে সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আওতায় সঞ্চয়পত্র কেনার কোটা কঠোরভাবে তদারকি করা হবে। কোটার বেশি সঞ্চয়পত্র কেউ কিনতে পারবে না।

এদিকে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানোর জন্যও সরকার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করার কারণে আমানতের সুদের হার বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে বেড়ে গেছে ঋণের সুদের হার।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঋণের সুদের হার ৪ থেক ৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। হার বেড়ে ১২ থেকে ১৮ শতাংশে উঠে গেছে। এ কারণে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে জোর আপত্তি উঠেছে। তারা বলেছেন, ঋণের সুদের হার বাড়ার কারণে ব্যবসা খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বিনিয়োগ বাড়ানো, ব্যবসার প্রসার ও প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে।

এ বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে উপস্থাপন করার পর খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঋণের সুদের হার কমিয়ে সিঙ্গেল জিডিটে নামিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ও বেসরকারি খাতের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরামউদ্দিন আহমেদকে বলেছেন।

একই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিষয়টি পর্যালোচনা করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়েছে।

সূত্র জানায়, বর্তমানে ব্যাংকের আমানতের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের ঋণের সুদের হার বেশি। যে কারণে আমানতকারীরা এখন সঞ্চয়পত্রমুখী। ব্যাংকে আমানতের সুদের হার বাড়লেও গ্রাহকরা এখনো ব্যাংকমুখী হচ্ছেন না। যে কারণে ব্যাংকে তারল্য সংকট রয়ে গেছে। এ ছাড়া ব্যাংকে আমানতের সুদের হার আরও বাড়ানো হলে ঋণের সুদের হারও বেড়ে যাবে। এ কারণে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে এবং শেয়ারবাজারকে বেশি চাঙ্গা না করে আমানতকে ব্যাংকমুখী করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

এ ছাড়াও সঞ্চয়পত্র থেকে এখন চড়া সুদে সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে, যা বাজেটের ওপর বড় ধরনেরে চাপ তৈরি করছে। এই চাপ কমাতেও সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমাতে চায়। এর আগে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ২০১৫ সালের ২৩ মে কমানো হয়ছিল।

এ প্রসঙ্গে তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সঞ্চয়য়ের ক্ষেত্রে মানুষ যেখানে নিরাপত্তা ও বেশি মুনাফা পাবে, সেখানেই যাবে। এখন সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বেশি এবং আস্থাও বেশি। এসব কারণে এদিকে মানুষের ঝোঁক বেশি। ব্যাংকের ক্ষেত্রে আমানতকারীদের যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, এতে শুধু সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমালেও মানুষ ব্যাংকমুখী হবে না। এর সঙ্গে আস্থার বিষয়টিতেও গুরুত্ব দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, সঞ্চয়পত্রকে লাভ-ক্ষতির ভিত্তিতে দেখলে চলবে না। এর পেছনে অনেক স্বল্প আয় বা নির্দিষ্ট আয় বা পেশনভোগীর স্বার্থ জড়িত। অনেকেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে মুনাফার অর্থে জীবিকানির্বাহ করছেন। এটি সরকারের এক ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা। কেননা সরকার বিকল্প কোনো আয়ের ব্যবস্থা করতে পারছে না। ফলে এই হার কমানোর আগে ভেবে-চিন্তে দেখা উচিত।

সূত্র জানায়, বর্তমানে জাতীয় সঞ্চয় অধিপ্তরের অধীনে ৭ ধরনের সঞ্চয়ী উপকরণ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে-৩ বছর মেয়াদি তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র। এর মেয়াদান্তে এর মুনাফা ১১.০৪ শতাংশ। ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষে ১১.২৮ শতাংশ হারে মুনাফা দেওয়া হয়। ৫ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১১.৭৬ শতাংশ। ৫ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১১.৫২ শতাংশ।

প্রবাসীদের জন্য বৈদেশক মুদ্রা সঞ্চয়ের জন্য তিন ধরনের বন্ড রয়েছে। এর মধ্যে ৫ বছর মেয়াদি ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডের মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১২ শতাংশ। ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ডের মুনাফার হার ৭.৫০ শতাংশ ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের মুনাফার হার ৬.৫ শতাংশ। দুটিরই মেয়াদ ৩ বছর। এ দুটি সঞ্চয়পত্রের সুদের হার অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

জাতীয় ডাকঘরের অধীনে রয়েছে দুটি সঞ্চয়ী হিসাব। এর একটি হচ্ছে তিন বছর মেয়াদি হিসাব। এতে মুনাফার হার ১১.২৮ শতাংশ। সাধারণ হিসাবে মুনাফার হার ৭.৫ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভারেগ অধ্যাপক ড. এমএ তসলিম বলেন, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমালেই যে ব্যাংক খাত বা অন্যান্য খাত চাঙ্গা হবে-এমনটি নয়। বিনিয়োগ বৃদ্ধি করার জন্য সঞ্চয়পত্রে সুদের হার হ্রাস করার সুযোগ আছে; কিন্তু দেশের বিনিয়োগ-পরিবেশ যদি উন্নত না করা হয়, তা হলে সুদের হার হ্রাস করলেও সুফল পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া গ্রাহক শেয়ারবাজার ও সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে যে ব্যাংকে ভরসা রাখবেন এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।

এদিকে চলতি পুরো অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রথম নয় মাসেই (জুলাই-মার্চ), সে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি বিক্রি হয়ে গেছে। এ সময়ে নিট বিনিয়োগ এসেছে ৩৬ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা, যা পুরো অর্থবছরের জন্য সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ১২১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অর্থবছরের পুরো সময়ের জন্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের নিট ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।

সম্প্রতি ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীও বিনিয়োগ বাড়াতে সুদহার কমানোর পক্ষে মত প্রকাশ করে বলেন, সুদহার কমানোর পাশাপাশি যোগাযোগ অবকাঠামো সুবিধাসহ নিরবচ্ছিন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার অবকাঠামো খাতে ইতিমধ্যে অনেক কাজ করেছে। এর বড় প্রমাণ হলো, ২০০৯ সালে যেখানে মাত্র ৪৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ শতাংশে।

সাধারণ মানুষের জীবনমানের অনেক উন্নতি হয়েছে। তিনি বলেন, পরিসংখ্যান দিয়ে জীবন চলে না। আর সেটা অর্থবহ নয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশ হলো, না কি সাড়ে ছয় শতাংশ হলো, এ নিয়ে সাধারণ মানুষ মাথা ঘামায় না। বরং এ সময়ে তাদের জীবনমান উন্নয়ন হয়েছে কি না তা দেখতে হবে। গত পাঁচ বছরে মানুষের জীবনমানের অসামান্য উন্নতি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে।

ড. বিরুপাক্ষ পাল বলেন, বর্তমানে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার ১৫ শতাংশ। সুদহার বেশি হওয়ায় কাক্সিক্ষত মাত্রায় বিনিয়োগ হচ্ছে না। সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে আনতে পারলে বিনিয়োগ দ্রুত বাড়বে। মুদ্রানীতি পূর্ণভাবে কার্যকরণের জন্য সুদহার নিয়ন্ত্রণের পুরো ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে দিতে হবে।

এতে সুদহার কমানোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ আরো সহজ হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে মানুষ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে। এতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ব্যাংকে আমানতের পরিমাণও কমছে। তিনি বলেন, দেশের পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে হলে দ্রুত সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমাতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ। গত কয়েক বছর বাংলাদেশ ব্যাংক ভালোভাবেই সেই দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু সুদহার বেশি থাকায় বিনিয়োগ বাড়ছে না। সুদহারের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। যা বিনিয়োগের জন্য বড় বাধা। সঞ্চয়পত্রের বিদ্যমান সুদহারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই সুদহার কমানোর বিষয়ে সরকারের কাছে মতামত জানিয়েছে।

বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন. গত কয়েক বছর সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও সেই হারে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়েনি। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। এ ছাড়া এখনো বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সমস্যা রয়ে গেছে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি উল্লেখ করে এর সুদের হার কমানোর পরামর্শ দেন তিনি। একই সঙ্গে জ্বালানির ওপর ভর্তুকি কমানোরও সুপারিশ করেন নাজনীন আহমেদ।

এস এ সামাদ বলেন, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ ভালো। তার পরও বিদেশি বিনিয়োগ কম। বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সবাইকে চেষ্টা করতে হবে। এ সময় তিনি হুন্ডিসহ বিভিন্ন অবৈধ লেনদেন রোধ করতে আরো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি আহবান জানান।

প্রসঙ্গত, তুলনামূলক সুদহার বেশি হওয়ায় চলতি অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা মাত্র পাঁচ মাসে অতিক্রম করেছে। এই পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স¤প্রতি সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১২ শতাংশ।