dseফাতিমা জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার বান্ধব বাজেট আসছে নির্বাচনী বছর। কারন নির্বাচনী বছর পুঁজিবাজারকে চাঙ্গা রাখতে হলে বাজার বান্ধব বাজেটের বিকল্প নেই। আগামী অর্থবছরের ঘোষণা করতে যাওয়া বাজেটের দিকেই চেয়ে রয়েছে বিনিয়োগকারীরা। জনসংখ্যা, আয়তন ও অর্থনীতির অগ্রগতির তুলনায় দেশের পুঁজিবাজারের বিকাশ হচ্ছে না।

তাই বাজারের উন্নয়ন ও প্রসারতা বৃদ্ধির জন্য পুঁজিবাজার বান্ধব বাজেট চায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই ও সিএসই), বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকারস অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ), ডিএসই ব্রোকাস অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ)সহ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিষ্ঠানগুলোর বক্তব্য- বর্তমানে পুঁজিবাজারে ৩২ লাখ বিনিয়োগকারী রয়েছে।

বাজার বান্ধব বাজেট হলে পুঁজিবাজার চাঙ্গা থাকবে, এতে নতুন করে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী ও কোম্পানি বাজারে আসবে। বাজারের আকার বাড়বে। ফলে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পুঁজিবাজারের অবদান বাড়বে। সরকার এই খাত থেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি রাজস্ব আয় পাবে।

কারণ আগামী বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য কোন প্রণোদনা বা বিশেষ কিছু থাকবে কিনা সেটি নিয়েও বিনিয়োগকারীদের মাঝে নানা আলোচনা চলছে। এর আগে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ ও বাজার মহলদের বাজেটকে ঘিরে নানা তৎপরতা থাকলেও এবার কিছুটা ভাটা পড়ায় সন্দেহ আরও প্রবল হয়েছে।

বিশেষ করে নতুন অর্থবছরে বাজেটের আগে এভাবে টানা দরপতনই বলে দিচ্ছে হয়ত আগের মতো প্রণোদনা নাও থাকতে পারে। তবে আসন্ন বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা হবে সংশ্লিষ্ট সব মহলে আলোচনা শোনা গেলেও চ‚ড়ান্ত বাজেটে এর প্রতিফলন নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে। তেমনি বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্য এবারের বাজেট বাজার বান্ধব হবে বলে খোদ অর্থমন্ত্রী বলেছেন। তবে অর্থমন্ত্রীর ঘোষনার পর থেকে বিনিয়োগকারীদের মাঝে আলোচনার শেষ নেই।

বিনিয়োগ এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশে বাজেটে কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে বলেও জানা যায়। তবে এ নিয়ে পুঁজিবাজারে চলছে আলোচনা। এবারের বাজেট কেমন হবে কতটা পুঁজিবাজার বান্ধব হবে এ প্রশ্ন খোদ বিনিয়োগকারীদের। আগামী বাজেটে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতাকে গুরুত্বারোপ করা হবে। বাজার পতনের দায় নিতে যাবে না বাংলাদেশ ব্যাংক।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এছাড়াও সঞ্চয় পত্রে সুদ হার কামানোর ঘোষণায়ও মানুষ একটু বেশি মুনাফার আশায় পুঁজিবাজারমুখী হচ্ছেন অনেকে। আর যে আশায় বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন তা ধরে রাখার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহনের আহবান জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। বিশ্বের সব পুঁজিবাজারেই উত্থান-পতন আছে। এটা খুবই স্বাভাবিক। এর মধ্য থেকেই বাজার থেকে গেইন করে নেওয়াই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ।

তারা বলছেন, আসন্ন বাজেটে পুঁজিবাজারকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা দেখেছি অর্থমন্ত্রীর প্রাক-বাজেট আলোচনায় নানাবিধ আর্থিক সংগঠন ও ব্যবসায়িরা অংশগ্রহণ করে তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন। কিন্তু পুঁজিবাজার দেশের অর্থনীতির অন্যতম উৎস হওয়া সত্বেও এর প্রতিনিধি তথা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকে কোন আলোচনায় দেখা যায়নি।

যদি এ বিষয়ে কোন সমন্বয়ের অভাব থাকে তাহলে তার সমাধান করা দরকার। কারণ বাজেটে বিনিয়োগকারীদের অভিভাবক তাদের দাবীগুলো তুলে ধরুক এটা সকলেরই কাম্য। সাথে সাথে একটি বিষয় সকলের মনে রাখা দরকার, যে দেশের পুঁজিবাজার যত বেশি শক্তিশালী, সে দেশের অর্থনীতি তত শক্তিশালী।

শেয়ারবাজারকে কাজে লাগিয়ে দেশের শিল্পোন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন একটি বিনিয়োগ বান্ধব বাজেট। অনেকে এও বলেছেন, দাবী মোদের একটাই পুঁজিবাজার বান্ধব বাজেট চাই।

পুঁজিবাজার দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের ক্ষেত্র হলেও বাংলাদেশে তা হচ্ছে না বলে হতাশ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি জানিয়েছেন, আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ বিষয়ে নীতি সহায়তা থাকবে।

২০০৯ সালের পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার চার গুণেরও বেশি বেড়েছে, বাজেটও বেড়েছে সমপরিমাণ, কিন্তু সেই তুলনায় পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি হতাশাজনক। ২০১০ সালের ধসের পর এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বাজার। ২০১৭ সালে বাজারে সূচক দেড় হাজারেরও বেশি বাড়লেন চলতি বছরের শুরুর দিকে বাজারে আবার মন্দার মধ্যে দেখা দেয়। প্রায় এক হাজার পয়েন্টের মতো কমেছে সূচক। এ নিয়ে চরম হতাশ বিনিয়োগকারীরা।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আর এই বিনিয়োগের উৎস হবে পুজিবাজার।’ ‘কিন্তু আমাদের পুঁজিবাজার দুর্বল হওয়ার কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ বাড়াতে কাজ করছেন।’

কিছু কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের চেষ্টা করছে। কিন্তু এটা ব্যাংকের কাজ নয়। পুঁজিবাজারকে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের উৎস হিসেবে তৈরি করতে আগামী বাজেটে নীতি সহায়তা থাকবে।’ বাজেটের পর দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ বাড়াতে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করা হবে বলেও জানান অর্থমন্ত্রী।

page 1 (71)পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসির চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন বলেন, ‘পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন বিদেশি বিনিযোগ। স¤প্রতি চীনের দুইটি কোম্পানি বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে চুক্তি করেছে। এতে করে পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে।’ ‘আমাদের পুঁজিবাজারের প্রধান সমস্যা হলো, ক্ষুদ্র বিনিযোগকারীরা গুজবের ওপর নির্ভর করে বিনিয়োগ করে।’

বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফ্যান বলেন, ‘বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় প্রবেশ করেছে। এখান থেকে আগামীতে মধ্যম আয়ের দেশে যেতেহলে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ হতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন। বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর ফজলে কবির বলেন, ‘২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়শীল দেশের তালিকায় প্রবেশ করার জন্য আমাদের এখন থেকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। সেজন্য দেশে দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।’ ‘আমাদের রপ্তানি পণ্যের তালিকা আরও বাড়াতে হবে।

একটি দুইটি খাতের ওপর নির্ভর না করে নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন দেশি বিদেশি বিনিয়োগ।’ ‘বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। পাশাপাশি বন্ড মার্কেটের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।’

বাজার বিশ্লেষকরা বলেছেন, পুঁজিবাজার হযবরল অবস্থা বিরাজ থাকলেও খুব শিগরিই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। নির্বাচন সামনে রেখে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়বে। এর একটি অংশ আসবে পুঁজিবাজারে। যারা নির্বাচন করবেন তাদের আত্মীয়স্বজনরা বিদেশ থেকে অর্থ পাঠাবেন। এর একটি অংশও পুঁজিবাজারে যাবে।

সরকারও পুঁজিবাজার চাঙ্গা রাখতে উদ্যোগী হবে। কেননা ভোটের বছর সব সরকারই পুঁজিবাজার ভালো রাখার চেষ্টা করে। পুঁজিবাজারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বিনিয়োগকারী ও তাদের ওপর নির্ভরশীল মিলে প্রায় ১ কোটি ভোটার রয়েছে। এ কারণে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের তুষ্ট করতে পারলে এই ভোটের একটি অংশ সরকারের দিকে ঝুঁকবে। যার ফলে পুঁজিবাজার বান্ধব বাজেটের বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, তবে এবারের বিনিয়োগবান্ধব বাজেট ঘোষণা করা বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য চ্যালেঞ্জ। তারপরও সার্বিকভাবে বিনিয়োগবান্ধব বাজেটের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে। সরকারের শেষ সময়ে পুঁজিবাজার যাতে গতিশীল থাকে, সে বিষয়টিও গুরুত্ব দেওয়া হবে বাজেটে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখতে সর্ব প্রকার সরকার সহযোগিতা করবে। কারন সরকার এ দুর্নাম আর নিতে চায় না। পাশাপাশি সরকারের আন্তরিকতায় পুঁজিবাজার স্থিতিশীল থাকবে। তবে এ ধারা যেন অব্যাহত থাকুক, তা চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাই নতুন বাজেটে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতার বিষয়টি গুরুত্বারোপ করা হবে।

এর আগে গত মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর পুঁজিবাজারে নজরদারি বাড়ানো দরকার এবং ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ আইনে নির্ধারিত সীমার মধ্যে রাখার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির কথা বলেছিল। এর পর থেকেই বাজারে পতন শুরু হয়। তবে এবার পুঁজিবাজার নিয়ে বক্তব্যে সতর্কতা অবলম্বন করা হবে বলে জানা গেছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান বলেন, নির্বাচনী বছর সরকার যে কোন ভাবে পুঁজিবাজার চাঙ্গা রাখবে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন এবারের বাজেট বাজার বান্ধব হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে দেখবেন, ব্যাংক খাতের চেয়ে পুঁজিবাজার বেশি জনপ্রিয়। কারণ পুঁজিবাজার থেকে টাকা উত্তোলন করতে সুদ দিতে হয় না। ফলে সেই সব দেশের অর্থনীতির ৯০ শতাংশ অবদান পুঁজিবাজারের, আর বাকি ১০ শতাংশ অবদান ব্যাংকের। কিন্তু আমাদের দেশে সম্পূ্র্ণ উল্টো। তাই পুঁজিবাজারের জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়া দরকার।

ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কে এ এম মাজেদুর রহমান বলেন, ৭ শতাংশ জিপিতে বর্তমানে পুঁজিবাজারে অবদান ২০ শতাংশ। আগামী তিন বছর পর এই অবদান বেড়ে হবে ৫০ শতাংশ। তার জন্য দরকার পুঁজিবাজার বান্ধব বাজেট এবং সরকারের বিশেষ সহায়তা।