ipo lagoদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: প্রাথমিক গণ প্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে টাকা উত্তলনের পরও কোম্পানিগুলোর আয় না বেড়ে বরং ধারাবাহিকভাবে কমছে। পূর্বে যে আয় হতো আইপিওর মাধ্যমে টাকা উত্তলনের পর সে আয়েও পরেছে ভাঁটা। এমনকি লেনদেন শুরুর পাঁচ বছরের মাথায় ইস্যু মূল্যের নিচেও নেমে গেছে বেশীরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর। সম্প্রতি পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করা কোম্পানিগুলোর আর্থিক বিবরণী পর্যালোচনায় এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ব্যবসা সম্প্রসারণ, নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ, চলতি মুলধন যোগান কিংবা ব্যাংক ঋণ পরিশোধে পুঁজিবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে কোম্পানিগুলো। আর অর্থ সংগ্রহ করার পর স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানিগুলোর আয় যেখানে বাড়ার কথা সেখানে উল্টো কমে গেছে।

অভিযোগ রয়েছে, শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের পূর্বে ‘উইন্ডো ড্রেসিং’ এর মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করে । এতে কোম্পানিগুলো প্রকৃত আর্থিক অবস্থার চেয়ে ভালো অবস্থা দেখিয়ে প্রিমিয়াম নিয়ে বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে।

যার ফলে প্রতিনিয়ত ক্ষতির মূখে পরে ওইসব কোম্পানিতে ইনভেস্ট করা বিনিয়োগকারীরা। সাধারণত নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নিরব ভুমিকার কারণেই কোম্পানিগুলো এমন কারসাজি করার সূযোগ পায় বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পুঁজিবাজারে নতুন তালিকাভ‚ক্ত হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে ১২টি ২০১৬ সালে ও ২টি ২০১৭ সালে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স সূচকে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। এরমধ্যে ২০১৬ সালের ২৪ জানুয়ারি ১০টি কোম্পানি, ২৪ জুলাই ও ২৩ অক্টোবর এবং ২০১৭ সালের ২৩ এপ্রিল ও ২২ অক্টোবর একটি করে কোম্পানি অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।

এই ১৪টি কোম্পানির মধ্যে ৯টি বা ৬৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম অন্তর্ভূক্তিকালীন সময়ের তুলনায় নিচে নেমে এসেছে। যা ডিএসইএক্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আর বাকি ৫টি বা ৩৬ শতাংশ কোম্পানি সূচকে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

মূল্যসূচকে অন্তর্ভূক্ত হওয়া নতুন কোম্পানিগুলো হল: প্যাসিফিক ডেনিমস, বিবিএস কেবলস, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইল, কেডিএস এক্সেসরিজ, আমান ফিড, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ, জাহিন স্পিনিং, হামিদ ফেব্রিকস, ন্যাশনাল ফিড, তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ, ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন, ডরিন পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড সিষ্টেমস ও একমি ল্যাবরেটরিজ।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, ‘কোন কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে কোম্পানিটির ভবিষ্যত কেমন হবে তা অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত। কেননা অর্থ সংগ্রহের পরই কোম্পানিগুলোর আয় কমে যাওয়ার অর্থেই হচ্ছে আইপিওতে আসার আগে তারা যে আর্থিক প্রতিবেদন দিয়ে থাকে সেগুলো সঠিক নয়।

অতিরিক্ত প্রিমিয়াম আদায় করতে আইপিওতে আসার আগে কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফা ও সম্পদ বাড়িয়ে দেখিয়ে থাকে। আর এজন্য কোম্পানির তথ্যগুলোর যথার্থতা বিএসইসির যাচাই করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।’ তবে আইপিও অনুমোদন নিয়ে কোন ধরনের অনিয়মের কথা নাকচ করে দিয়েছেন বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন।

সম্প্রতি ‘ডিএসই-মোবাইল’ নামে নতুন অ্যাপস চালু উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘গত ৫ বছরে কোন কোম্পানির আইপিও নিয়ম বহির্ভূতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। কোন কোম্পানির ব্যবসায়িক ফলাফলের সাথে বিএসইসির কোন সম্পর্ক নেই।

আকর্ষণীয় আর্থিক প্রতিবেদন দাখিল করে শেয়ারবাজার থেকে প্রতিনিয়ত অর্থ তুলছে নতুন নতুন কোম্পানি। তবে এসব কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পরেই তাদের আর্থিক অবস্থায় নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ফলে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম কমে গিয়ে বাজারের মানদন্ড নির্ধারক মূল্যসূচকে বিরুপ প্রভাব ফেলছে।

এছাড়া নতুন কোম্পানির শেয়ারের লেনদেনের শুরুতে অস্বাভাবিক ও কৃত্রিম চাহিদা থাকলেও তা পরবর্তীতে কমে যাওয়ায় বিরুপ প্রভাব পড়ছে।

বাজার বিশ্লেষনে দেখা গেছে, শেয়ারবাজারে নতুন তালিকাভ‚ক্ত হওয়া ৬৪ শতাংশ কোম্পানিই মূল্যসূচকে বিরুপ প্রভাব ফেলেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূল্যসূচকে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে অন্তর্ভুক্ত হওয়া নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ওপর পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

ডিএসইর সাবেক উপ-মহাব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিন জানান, একটি কোম্পানি ডিএসইএক্স সূচকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরে যদি শেয়ারের দাম কমে যায়, তাহলে ওই কোম্পানি সূচকে বিরুপ প্রভাব ফেলে। ঠিক একইভাবে শেয়ারের দাম বাড়লে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে কোম্পানিটি যে দাম নিয়ে অন্তর্ভূক্ত হয়, সে তুলনায় কমেছে নাকি বেড়েছে তা বিবেচনায় আসবে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিএসইর মূল্যসূচক গণনা করা হয় ফ্রি ফ্লট ভিত্তিতে।

একটি কোম্পানির যে পরিমাণ শেয়ার বাজারে স্বাভাবিক লেনদেন হয় তাই ফ্রি ফ্লট। অর্থাৎ স্পন্সর, পরিচালক, প্লেসমেন্ট, ক্রস হোল্ডিং (একই গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানের দখলে থাকা শেয়ার), স্ট্র্যাটেজিক বিনিয়োগকারীর শেয়ার বা অন্য কোনভাবে লকিং থাকা শেয়ার সূচক গণনায় বিবেচনায় নেওয়া হয় না।

তারা বলছেন, যেহেতু সূচক গণনা করা হয় ফ্রি ফ্লট ভিত্তিতে, তাই একটি কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন যত বেশিই হোক ওই কোম্পানির শেয়ারের মূল্যের ভিত্তিতে সূচকে বড় ধরণের উত্থান-পতন হয় না। তবে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন যাই হোক এর শেয়ারের দাম কমা অথবা বাড়ার ওপর সূচকে কিছু না কিছু প্রভাব পড়বেই।

তাদের মতে, শেয়ারবাজারে তালিকাভ‚ক্তির আবেদনের সময় কোম্পানিগুলো আকর্ষনীয় আর্থিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করছে। কিন্তু তালিকাভ‚ক্তির পরেই তাদের আর্থিক অবস্থায় নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠে কোম্পানিগুলো প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) আবেদনের সময় সঠিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে কিনা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, যদি ২০১৬ ও ২০১৭ সালে সূচকে অন্তর্ভূক্ত হয়েই ৬৪ শতাংশ কোম্পানি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, সেটা শেয়ারবাজারের জন্য দুঃখজনক। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। একইসঙ্গে আইপিও অনুমোদন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।

এএফসি ক্যাপিটালের প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা (সিইও) মাহবুব এইচ মজুমদার বলেন, যেকোন কোম্পানির শুরুতে ইস্যু মূল্যের তুলনায় কয়েকগুণ দরে শেয়ার লেনদেন হয়। এটা একটা সাংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের অস্বাভাবিক চাহিদা তৈরী হওয়ায় এমনটি হয়। যা ঠিক না। আর এই অস্বাভাবিক চাহিদা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন দর কমতে থাকে। যাতে মূল্যসূচকে বিরুপ প্রভাব পড়ে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক রিসার্চ কর্মকর্তা মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, সূচকে অন্তর্ভূক্ত যে কোন কোম্পানির শেয়ারের দাম কমলেই সূচকে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে নতুন তালিকাভুক্ত হওয়ার অধিকাংশ কোম্পানিই সূচকে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে কোম্পানিগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক।

তিনি বলেন, শেয়ারবাজারের নতুন নতুন কোম্পানি আনতে হবে। তবে ভালো কোম্পানির বদলে খারাপ কোম্পানির বাজার থেকে টাকা তোলার সুযোগ দিলে তা বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আইপিও অনুমোদন দেওয়ার সময় সতর্কভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।