dse dorpotonফাতিমা জাহান ও মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক গতিকে মন্থর ও অস্থিতিশীল করে তুলছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। সাম্প্রতিক সময়ে টানা ১৩ কার্যদিবসের ধারাবাহিক দরপতনের নেপথ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা জড়িত বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর রশীদ।

এদিকে কারসাজি চক্রের সক্রিয়তায় দেশের পুঁজিবাজারে নিয়মিত পতনের মাত্রা বাড়ছে। এতে বিনিয়োগকারীদের মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থাও চিন্তিত। বাজারে আস্থার সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। ধারাবাহিক পতনে বাজার বিশেষজ্ঞরা আশঙ্ক করছেন আবারও মহাধ্বসের দিকে যাচ্ছে বাজার। চলতি বছরের শুরু থেকে সূচক ও লেনদেনে মন্দাভাব অব্যাহত রয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন করে ভীতি তৈরি হয়েছে। কোনোভাবেই পতনের লাগাম টানতে পারছে না কোনো সংস্থাই।

এ প্রসঙ্গে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সাদেক বলেন, পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি বাংলাদেশ ব্যাংককের কারণেই হচ্ছে। কারণ হলো প্রাতিষ্ঠানিক বড় বিনিয়োগকারীদের থেকে যে সাপোর্ট আমরা পেতাম; সেটা এবার পর্যাপ্ত নয়। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ফান্ড থাকার পরও এক্সপোজারের কারণে তারা বিনিয়োগ করতে পারছে না। বিনিয়োগ করলেই তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়।

তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু বিষয়ে নমনীয় হলেই বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে। মোস্তাক আহমেদ সাদেক বলেন, বাজারে সাপোর্ট দিতে আমরা আইসিবিকে বরাবরই শক্তিশালী অবস্থান নিতে দেখেছি। তবে খোদ আইসিবিকেই যদি দুর্বল করে রাখা হয়; তাতে সাপোর্ট লেবেলও দুর্বল হয়ে যায়।

মার্চেন্ট ব্যাংক অ্যাসোসিয়শনের সভাপতি নাসির উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক জেগে ঘুমাচ্ছে। অর্থমন্ত্রীও বাংলাদেশ ব্যাংককে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সহযোগিতায় করার জন্য বলেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তা করছে না। তিনি বলেন, বর্তমানে আইসিবির কাছেও পর্যাপ্ত মূলধন নেই। তাই তারাও বাজারে সাপোর্ট দিতে পারছে না। নাসির উদ্দিন বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। তারা তাদের সাবসিডিয়ারির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারের বর্তমান অবস্থা ১৯৯৬ সালের চেয়েও ভয়াবহ। ১৯৯৬ সালের বাজারে ঋণের কোনো বিষয় ছিল না। তখনকার বাজারে বিনিয়োগকারীদের পুরোটাই ছিল তাদের নিজস্ব বিনিয়োগ। তাই তখন যারা শেয়ার নিজের নামে হস্তান্তর করে অপেক্ষা করেছিলেন, তারা দীর্ঘ সময় পর হলেও মুনাফা পেয়েছেন।

কিন্তু এবার টানা দরপতনের কারণে ইতোমধ্যে অনেকেই তাদের নিজস্ব বিনিয়োগের পুরোটাই হারিয়েছেন। এমনকি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ঋণেরও পুরোটাই প্রায় যায় যায় অবস্থা। এ জন্য বিনিয়োগকারীর চেয়ে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোই এখন ঝুঁকিতে রয়েছে।

ডিবিএর সাবেক সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী বলেন, আর্থিক বাজারেই তারল্য সংকট রয়েছে। ফলে এর প্রভাব পুঁজিবাজারেও লেগেছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের অধ্যাপক. ড. মিজানুর রহমান বলেন, আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা, কুঋণ এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা (বিশেষ করে ব্যালেন্স সিটের দুর্বল কোয়ালিটি), সুদের হার বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বাজারে নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে।

এদিকে পুঁজিবাজারে অব্যাহত দরপতনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। প্রতিনিয়তই তাদের পোর্টফোলিওর অবস্থা নাজুক পর্যায়ে চলে এসেছে। এমতাবস্থায় ডিএসই সামনে আজও মানববন্ধন করেছেন বিনিয়োগকারীরা। বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে মানববন্ধন করেন বিনিয়োগকারীরা।

মানববন্ধনে শেয়ারবাজার পতনের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি চেয়ারম্যান এবং অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি জানানো হয়। একইসঙ্গে কারসাজি চক্রের হাত থেকে বাজারকে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন বিনিয়োগকারীরা।

বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারন সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বলন, শেয়ারবাজারে পরিকল্পিতভাবে দরপতন ঘটানো হচ্ছে। এর প্রতিবাদের আমরা আজ রাস্তায় নেমেছি। এর পরিবর্তন না হলে আমরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ২০১০ সালে যে চক্র শেয়ারবাজার থেকে পরিকল্পিতভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ হাতিয়ে নেই, সেই চক্রই আবার বাজারে সংক্রিয় হয়েছে। তারা পরিকল্পিতভাবেই এমন অবস্থার সৃষ্টি করছে। ২০১০ সালে যারা শেয়ারবাজার অস্থিতিশীল করেছিল তাদের বিচার চাই। বাজার যতদিন স্বাভাবিক না হবে আমাদের আন্দোলন চলবে।

তিনি আরো বলেন, তৃতীয় মেয়াদে বর্তমান চেয়্যারম্যানকে দায়িত্ব দেওয়াটা ভালোভাবে নেয়নি বিনিয়োগকারীরা। কারণ, পূর্ববর্তী দুই দফায় বর্তমান চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন দায়িত্ব পালন করলেও তিনি ভালো কিছু দিতে পারেননি। তাই সাইডলাইনে রয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা।

জানা যায়, সা¤প্রতিক সময়ে ১৩ কার্যদিবসে ধারাবাহিক পতনের আগে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) স্ট্রাটেজিক পার্টনার ইস্যুর সমাধান হয়। কিন্তু এর কিছু দিন আগেও কে হচ্ছে ডিএসই’র স্ট্রাটেজিক পার্টনার- এমন প্রশ্নে সূচক ও লেনদেনে মন্দা অব্যাহত ছিল।

এছাড়া ঋণের বিপরীতে সুদ হারের অনুপাত (এডিআর) ও নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) ইস্যুতে বাজার টানা দরপতনে ভুগেছিল। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর সক্রিয়তায় উভয় ইস্যুর সমাধান হয়েছে। কিন্তু তার পরেও টানা নিম্নমুখী রয়েছে বাজার।