dseমহিউদ্দিন ফারুক, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: টানা ১৩ কার্যদিবসের পতনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূলধন হারিয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধুমাত্র রবিবার এক দিনে কমেছে ৭৮.১৪ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার দর। ফলে তিন হাজার ৭৬২ কোটি টাকা মূলধন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ডিএসই। ১৪ দিনে লেনদেন কমেছে ২১৩ কোটি টাকার বেশি।

শুধু তাই নয়, ধারাবাহিক এ পতনে ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে ৪২৩ পয়েন্ট। আর সিএসই সার্বিক সূচক কমেছে এক হাজার ৫০ পয়েন্ট। এর মাধ্যমে এক বছর আগে ফিরে গেল পুঁজিবাজার। অব্যাহত পতনের আতঙ্কে পড়েছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। প্রতিবাদে গতকাল রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন শতশত বিনিয়োগকারী।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে পুঁজিবাজারে প্রতিদিনই পতন হচ্ছে। কেনা দামের চেয়ে অনেক নিচে নামায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। তবু টনক নড়ছে না কর্তৃপক্ষের।

এ প্রসঙ্গে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সাদেক বলেন, বাজারে যে টানা দরপতন দেখা দিয়েছে তার মূল কারণ কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশিত লভ্যাংশ দিতে পারেনি। বিশেষ করে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের কোম্পানিগুলো ভালো লভ্যাংশ দেয়নি। ফলে বাজারে এক ধরনের তারল্য সংকটও দেখা দিয়েছে।

তিনি বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশও ভালো না হওয়ায় বাজারে শেয়ার বিক্রির চাপ বেশি। সেজন্যই বাজারে নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ২৬ এপ্রিল থেকে দর পতনে দেশের প্রধান পুঁজিবাজারের ডিএসই মূলধন হারিয়েছে ২০ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা। টানা ১৩ দিনের পতনে প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে এক হাজার কোটি টাকার বেশি মূলধন কমেছে। গত ২৬ এপ্রিল পুঁজিবাজারে মূলধন ছিল চার লাখ চার হাজার ৬৬৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

১৩ কার্যদিবস পর গতকাল রবিবার মূলধন দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৮৩ হাজার ৭০১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। শুধুমাত্র গত রোববার একদিনে মূলধন কমেছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বলা যায়, ২১ হাজার কোটি টাকা পুঁজিবাজারের বাইরে চলে গেছে।

এদিকে সূচকের পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক কমেছে ৪২৩ পয়েন্ট। ২৬ এপ্রিল ডিএসইর প্রধান সূচক ছিল পাঁচ হাজার ৮১৩ পয়েন্ট। সর্বশেষ রবিবার এই সূচক কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৩৯০ পয়েন্ট। পাশাপাশি প্রতিদিন বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে। গতকাল ৭৮ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার দর কমেছে। একই সঙ্গে ১৩ দিনে লেনদেন কমেছে ১৫১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। আর ১৪ দিনে ব্যবধানে লেনদেন কমেছে ২১৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।

বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা ইতিবাচক ইস্যু থাকার পরও কেন বাজার উঠে দাঁড়াতে পারছে না সে দুশ্চিন্তা বিনিয়োগকারীসহ নানা মহলে বিরাজ করছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বাজারের পতন ঠেকাতে দৃশ্যত কোনো কাজ করছে না।

আর লেনদেন কম হওয়া কিংবা বাজার পতনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে প্রথমেই ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) দায়ী করা হয়। আসলে বর্তমান বাজার পতন আইসিবিকেই ঘিরে হচ্ছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আইসিবি সোনালী কিংবা জনতা ব্যাংকের কাছ থেকে লোন নিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে থাকে। শেয়ার দর বৃদ্ধি পেলে সেগুলো বিক্রি করে লোন পরিশোধ করার পাশাপাশি মুনাফাও করে আইসিবি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে যে, সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজার লিমিট ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের ১৫ শতাংশের বেশি হতে পারবে না।

আর আইসিবিকেও এ আইনের আওতায় বেধে রাখা হয়েছে। আগে এ আইনটি বলবৎ থাকলেও আইসিবি এর থেকে বাইরে ছিল। কিন্তু এক শ্রেণির বিনিয়োগকারীদের যোগসাজশে আইসিবিকে ফের এই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এখন আইসিবি আগে যেখানে সোনালী ব্যাংকের কাছ থেকে হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত লোন নিতে পারতো, এখন সেখানে তার চেয়ে অনেক কম পরিমাণ লোন নিতে পারে। যার ফলে আইসিবি আগের মতো মার্কেটে বিনিয়োগ করতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমাদের ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। অযৌক্তিকভাবে সরকারের নির্দেশনায় ব্যাংকের সিআরআর কমানো হয়েছে। এটি আর্থিক খাতের জন্য খুব একটা ভালো লক্ষণ নয়।

তবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সাতটি ব্যাংকের কিছু শেয়ার বিদেশিরা ছেড়ে দিয়েছেন। সুতরাং বিদেশিরা ব্যাংকের খুব বড় অঙ্কের শেয়ার ছাড়েননি। এ নিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের খুব বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২৬ এপ্রিল থেকে একটানা পতনের মুখে পুঁজিবাজার। গত রবিবারও পুঁজিবাজারে বড় দরপতন হয়েছে। বিক্রির চাপে কমছে শেয়ারের দাম। কোনো কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম এক-তৃতীয়াংশও কমেছে। বৃহৎ মূলধনী কোম্পানিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারে বেসরকারি ব্যাংকের মূলধন অনেক বেশি। এই ব্যাংকগুলো ২০১৭ সালে ভালো মুনাফা করতে না পারায় লভ্যাংশ কমেছে। কোনো কোনো ব্যাংক নগদ অর্থ জমা রেখে শুধু বোনাস শেয়ার ইস্যু করেছে। এতে ব্যাংক খাতের শেয়ারে বিক্রির চাপ বেশি। যার দরুণ পুঁজিবাজারে বড় প্রভাব পড়েছে।

ব্যাংকের ঋণ আমানত (এডিআর) কমানো হলে ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট দেখা দেয়। এ জন্যই বেসরকারি ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত সুদে আমানত সংগ্রহে মাঠে নেমে পড়ে। তবে এই সংকট কাটাতে ব্যাংক মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ এপ্রিল ব্যাংকে সিআরআর কমানো ও সরকারি আমানতের অর্ধেক বেসরকারি ব্যাংকে রাখার ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী। ঘোষণা অনুযায়ী, সিআরআর সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়।

পাশাপাশি সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকেও নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। সিআরআর কমানোয় ব্যাংকের ১০-১২ হাজার কোটি টাকা বাজারে এলেও সরকারি আমানত এখনো পায়নি বেসরকারি ব্যাংক।

ডিএসইর এক শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউসের এমডি নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, সুখবরেও পুঁজিবাজার উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই। সবাই শেয়ার বিক্রিই করছে। আর বিক্রির চাপে পতনও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। কোনো একটি গোষ্ঠী দাবি আদায়ে পরিকল্পনামাফিক পুঁজিবাজারকে ফেলে দিচ্ছে। বাজারের উন্নয়নে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কঠোর নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন বলেও জানান তিনি।