IPOআলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির যোগ্য হাজারেরও বেশি কোম্পানি। তারপরেও নানামুখী কারণে থমকে আছে আইপিও। গত কয়েক বছর ধরে এই সংখ্যা আরও কমেছে। বাজার বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেকোনো দেশে শক্তিশালী পুঁজিবাজার গড়তে তালিকাভুক্ত কোম্পানির (আইপিও) সংখ্যা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বাজারে আইপিও সংখ্যা যত বাড়বে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ততই বিকেন্দ্রীভ‚ত হয়। একইসঙ্গে বাজারের ব্যাপ্তি আরও বাড়ে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বর্তমানে দেশের শেয়ারবাজরে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) আসার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। তারা আরও বলেন, দুই-একটা কোম্পানি যা আসছে, তাদের মান নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। এ কারণে তালিকাভুক্তির পর লেনদেনের শুরুতে শেয়ারের যে দাম উঠছে, পরবর্তীতে তা ধরে রাখতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে মূল্যসূচকে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা অনেক কমেছে। অথচ বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজনে বিএসইসির উচিত ভালো কোম্পানিগুলোর সঙ্গে নেগোসিয়েশন করে শেয়ারবাজারে আনার পদক্ষেপ নেওয়া। বড় কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসলে বাজারের গভীরতা বাড়বে।

কোনো কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করতে চাইলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন সাপেক্ষে আইপিওর মাধ্যমেই আসতে হয়। পরবর্তীতে সেকেন্ডারি মার্কেটে শেয়ারগুলো লেনদেন হয়। অনেক বিনিয়োগকারী আছেন, যারা ঝুঁকি নিতে চান না, মূলত তাদেরই আগ্রহের শীর্ষে থাকে আইপিওর কোম্পানি।

কারণ আইপিওতে শেয়ার না পেলেও বিনিয়োগ করা পুঁজি ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে। অন্যদিকে সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগে বেশ ঝুঁকি রয়েছে। তাই ঝুঁকি এড়াতেই বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের শীর্ষে থাকে আইপির কোম্পানি।

page 1 (82)এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, আইপিও অনুমোদনে সময়ক্ষেপণের কারণে ভালো কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসছে না। এ কারণে কিছু কিছু দুর্বল কোম্পানি বাজারে আসছে। এমতাবস্থায় এই সমস্যা কাটিয়ে তোলার জন্য স্বল্প সময়ে আইপিও অনুমোদন দেওয়া দরকার।

তিনি বলেন, এই মুহূর্তে দেশে ট্রেক রেকর্ড ভালো এমন ১০০ টির বেশি কোম্পানি আছে। এসব কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনার পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দেশের ৯৫ শতাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অথচ শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিলে ফেরত দিতে হয় না, তারপরেও শেয়ারবাজারের সংখ্যা মাত্র তিন শতাংশ। এছাড়া ১০ শতাংশ কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া যায়। তারপরেও কোম্পানিগুলো কেন শেয়ারবাজারে আসছে না, তা খুঁজে বের করা দরকার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসইসির শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, আইপিও আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে চ‚ড়ান্ত অনুমোদনের জন্য কমিশন সভায় উপস্থাপন করতে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর সময় লেগে যায়। সংশোধিত বিধিমালার আলোকে আইপিও আবেদন নিয়ে তা যাচাই-বাছাই করতে অনেক সময় লাগে। ফলে আইপিও বাজারে কিছুটা হলেও শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে।

রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজের (আরজেএসসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা দেড় লাখ। এরমধ্যে ৫০ কোটি টাকার বেশি মূলধনের কোম্পানির সংখ্যা প্রায় এক হাজার। অথচ শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা মাত্র ৩০২টি।

বিএসইর বিধান অনুযায়ী, কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৫০ কোটি টাকা অতিক্রম করলেই ওই কোম্পানিকে পরবর্তী এক বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কোনো কোম্পানি ৫০ কোটি টাকার বেশি পরিশোধিত মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করলে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর তিন বছরের মধ্যে তালিকাভুক্তির বিধান রয়েছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা আরোপের পর একযুগ পার হলেও বেশিরভাগ কোম্পানিই তা মানছে না। তবে সরকারের নির্দেশনায় বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানিকে এ শর্ত থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭ সালে আইপিও আসে মাত্র সাতটি। গত নয় বছরের মধ্যে এক বছরে এত কম আইপিও আর কখনও আসেনি। শুধু তাই নয়, শেষ চার বছরে আইপিও আসার সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০১৪ সালে আইপিও আসে ২০টি। ২০১৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১২টিতে এবং ২০১৬ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় ১১টিতে। এদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে শেষ তিন বছরে ধারাবাহিকভাবে আইপিও আসার পরিমাণ বেড়েছে।

২০১৫ সালে ভারতের শেয়ারবাজারে আইপিও আসে ২১টি। এক বছরের ব্যবধানে ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয় ৮৩টি। ২০১৭ সালে আইপিও আসে ১৫৩টি। গত তিন বছরে যে কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে তার কোনোটিই প্রথমদিন যে দামে লেনদেন হয়েছে, পরবর্তীতে তা ধরে রাখতে পারেনি। এমনকি কিছু কিছু কোম্পানি আইপিওতে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছে, শেয়ারের দাম তারও নিচে নেমে গেছে।

ডিএসইর সাবেক পরিচালক খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন বলেন, অনেক কোম্পানি আছে সেগুলো সহসাই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তিতে আসতে পারে। কিন্তু তারা আগ্রহী হন না। এসব কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসতে হবে। নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্ত হলে পুঁজিবাজারের তারল্য একদিকে আটকে থাকে সত্য কিন্তু এটি বাজারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে বিনিয়োগকারীরা খারাপ কোম্পানিতে বিনিয়োগের সুযোগ কম পায়।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আইপিওতে অনেক আজেবাজে কোম্পানির শেয়ার আসছে। যেগুলো দাম ধরে রাখতে পারছে না। তারা শেয়ারবাজারে এসে কয়েকগুণ টাকা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের ফতুর করছে। বাজারে ভালো মানের শেয়ার আসছে না।

এ বিষয়ে ডিএসইর সাবেক পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তি ছাড়া পুঁজিবাজারের গভীরতা বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রতি মাসেই কিছু না কিছু কোম্পানিকে আইপিওর মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে সরকারি কোম্পানির প্রতি বিনিয়োগকারীরা আলাদা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সরকারি কোম্পানির তালিকাভুক্তিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবে সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সেগুলোর দিকেও নজর দেওয়া উচিত।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারি মোট ২৫টি কোম্পানির শেয়ার বাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২০১০ সালে। সাত বছর পার হলেও কোম্পানিগুলো শেয়ার ছাড়তে পারেনি। কবে ছাড়া হতে পারে, সেটিও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। তবে চলতি জুন মাসে সময় সীমা বেঁধে দেওয়া ছিল। কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড বা বিটিসিএল, সোনারগাঁও হোটেল, ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, লিকুফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস লিমিটেড বা এলপিজিএল,

সিলেট গ্যাস ফিল্ড, নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, বাখরাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড, জালালাবাদ গ্যাস সিস্টেম লিমিটেড, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড লিমিটেড, রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড।

এ কোম্পানিগুলোর মধ্যে নয়টি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের। বিদ্যুৎ বিভাগের চারটি। পাঁচটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের। পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তিনটি। এছাড়া ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের চারটি। সরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে তালিকাভুক্ত করার জন্য অনেকেই সুপারিশ করেছেন। তাছাড়া ব্যাংকের সুদের হার ও ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা সমন্বয় প্রয়োজন।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, আমাদের দেশে পুঁজিবাজার তুলনামূলকভাবে দুর্বল এবং জাতীয় বাজেটে বা জিডিপিতে এর অবদান অত্যন্ত কম মাত্র ২১ শতাংশ। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে এ অবদান ৮৬ শতাংশেরও বেশি এবং থাইল্যান্ডে প্রায় ১১৭ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে এর অবদান ১৪০ শতাংশ এবং সুইজারল্যান্ডে ২২৯ শতাংশ। এ অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ প্রয়োজন। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের গভীরতা কম।

ফলে মেনিপুলেশন সহজ হয় এবং তালিকাভুক্ত বা লিস্টেড ভালো কোম্পানির সংখ্যা খুবই কম। এ সংখ্যা বাড়ানো উচিত। আসন্ন বাজেটে যেসব কোম্পানি নতুনভাবে তালিকাভুক্ত হবে, তাদের আগামী দুই বছরের জন্য আয়করমুক্ত করা হলে অনেকে হয়তো লিস্টেড হতে পারে। নূন্যপক্ষে কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হলে ১৫ শতাংশ আয়কর যদি ছাড় দেওয়া যায় তাহলে কিছু কোম্পানি লিস্টেড হতে পারে।