Dse-upমোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে লেনদেনে অস্থিরতা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করছে। সরকারের নীতি নির্ধারকসহ সব মহলে আন্তরিকতার ফলে বাজার কিছুটা স্থিতিশীলতার আভাস ছিল। তবে বাজারের এ আভাসে পুরোপুরি এখনো দু:চিন্তা কাটছে না বিনিয়োগকারীদের। তারপর কিছুটা স্বস্তিতে তারা। কারন দীর্ঘ দিন পর বাজার কিছুটা স্থিতিশীলতার আভাসে বিনিয়োগকারীদের মাঝে স্বস্তির নি:শ্বাস ফিরে এসেছে।

ঈদ পরবর্তী বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীরা নতুন করে ভাবতে শুরু করছে। বিনিয়োগকারীরা বাজারের প্রতি আস্থা ফিরে পেলে নতুন করে বিনিয়োগ শুর করছেন। অধিকাংশ বিনিয়োগকারীদের হাতে টাকা থাকলেও বিনিয়োগ করার ভরসা পাচ্ছেন না। যে কারনে বাজার পর্যবেক্ষন করছেন তারা।

তবে বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে নিয়োগকারীদের আস্থার ফল হিসেবে এই ঘুরে দাঁড়ানো বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তবে সংশয়ও রয়েছে। কারণ গত প্রায় আট বছর ধরে বহুবার এভাবে স্থিতিশীলতার আভাস পাওয়া গেছে। কিন্তু কোনো বারই স্থায়ীভাবে স্থিতিশীলতার দিকে যায়নি বাজার পরিস্থিতি। তারপরও বিনিয়োগকারীরা একটি স্থিতিশীল বাজারের অপেক্ষার প্রহর গুনছেন প্রায় আট বছর।

এদিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগসীমার গণনা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণরকে আনুষ্ঠানিক চিঠির মাধ্যমে নির্দেশ দিয়েছেন।

অন্যদিকে, আগামী জুলাই থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজেটে নামিয়ে আনা হবে এমন ঘোষনা দিয়েছে ব্যাংকগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। এই দুই সুখবরে শেয়ারবাজারে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। এর আগে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে নির্ধারিত বিনিয়োগসীমার মধ্যে থেকেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে, সেজন্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অর্থ মন্ত্রণালয়ে দুটি প্রস্তাব প্রেরণ করে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার পাঠানো প্রস্তাব দুটির মধ্যে প্রথমটি হলো, অমেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডে উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগসীমা গণনা থেকে অব্যাহতি দেওয়া। অনুমোদন মিললে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমানে ১৪টি অমেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা এক হাজার ২২০ কোটি টাকা বিনিয়োগসীমার বাইরে চলে যাবে। তখন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে এই পরিমাণ অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে।

বিএসইসির দ্বিতীয় প্রস্তাব হলো, অ-রূপান্তরযোগ্য অগ্রাধিকারমূলক শেয়ার (নন-কনভার্টেবল প্রেফারেন্স শেয়ার), অ-রূপান্তরযোগ্য ডিবেঞ্চার ও অ-রূপান্তরযোগ্য বন্ড (নন-কনভার্টেবল বন্ড ও ডিবেঞ্চার) এবং শুধু ডেব্ট ইনস্ট্রুমেন্টে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যে বিনিয়োগ করে তাকেও বিনিয়োগসীমার বাইরে হিসাব করা। অনুমোদন মিললে বিদ্যমান বিনিয়োগসীমার মধ্যে থেকে সমপরিমাণ অর্থ শেয়ারবাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করার সুযোগ হবে।

জানা যায়, ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক এরই মধ্যে ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে এক্সপোজার হিসাব বিবেচনায় অ-রূপান্তরযোগ্য অগ্রাধিকারমূলক শেয়ার, ডিবেঞ্চার, বন্ড বাদ দেওয়ার নির্দেশনা জারি করেছে। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুর রহমান স্বাক্ষরিত এই দুই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এগুলো বাস্তবায়ন করা হলে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আসবে এবং বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ সহজতর হবে। এর ফলে বাংলাদেশের আর্থিক বাজার ও পুঁজিবাজারে বড় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করছে বিএসইসি। লিখিত প্রস্তাব দুটি গত ৪ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বিএসইসি।

ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা আছে, কোনো ব্যাংক তাদের পরিশোধিত মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম, বিধিবদ্ধ সঞ্চিতি, রিটেইন আর্নিংয়ের (টিয়ার-১ মূলধন) মোট পরিমাণের ২৫ শতাংশের বেশি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে না। বর্তমানে ১৪টি অমেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডে উদ্যোক্তা হিসেবে ১০টি ব্যাংক ও চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এক হাজার ২২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে।

প্রস্তাব দুটি গৃহীত হলে এই বিনিয়োগ বিনিয়োগসীমা গণনার মধ্যে পড়বে না। তখন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঁজিবাজারে মোট বিনিয়োগ নির্ধারিত ২৫ শতাংশের নিচে চলে আসবে। তখন তারা নতুন করে এক হাজার ২২০ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে।

কমিশনের মতে, অমেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডে উদ্যোক্তা হিসেবে বিনিয়োগ করা মোট ফান্ডের ১০ শতাংশ অর্থ দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। বিনিয়োগের এই অর্থকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসাবায়নের বাইরে রাখা হলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন নতুন মিউচ্যুয়াল ফান্ড গঠনে উদ্যোক্তার ভ‚মিকা পালন করতে পারবে। ফলে ফান্ড গঠনের জন্য বাকি ৯০ শতাংশ অর্থ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।

বিধি অনুযায়ী মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মোট অর্থের কমপক্ষে ৬০ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে হয়। বাকি ৪০ শতাংশ পুঁজিবাজারের বাইরে যেমন সরকারি সিকিউরিটিজ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঞ্চয় স্কিমে বিনিয়োগ করে থাকে। বর্তমানে ৮৬টি ফান্ডের অধীন প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে।

বিএসইসির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বে মিউচ্যুয়াল ফান্ড গঠনের ক্ষেত্রে সাধারণত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোক্তার ভ‚মিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশে বিদ্যমান ৭৬টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৪৩টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছে। ৩৯টি অমেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে ১৪টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান উদ্যোক্তা হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে।

এর মধ্যে ১০টি ফান্ডে ব্যাংক ও চারটি ফান্ডে আর্থিক প্রতিষ্ঠান উদ্যোক্তার ভ‚মিকা পালন করছে। এই ১৪টি অমেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এক হাজার ২২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ আটকে রয়েছে। কমিশন শর্ত শিথিল করলে সমপরিমাণ অর্থ পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।

বর্তমানে মেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের উদ্যোক্তার বিনিয়োগ করা অর্থের ১০ শতাংশ ফান্ডের মেয়াদ পর্যন্ত রেখে দিয়ে বাকি অর্থ এক বছর পর বিক্রি করতে পারে। আর অমেয়াদি মিউচ্যুয়াল ফান্ড হলে বিনিয়োগ করা অর্থ ফান্ড গঠনের তারিখ থেকে অন্তত তিন বছর পর্যন্ত সার্বক্ষণিকভাবে সংরক্ষণ করতে হয়।

বিএসইসির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজার তথা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ কর্মকাÐ ত্বরান্বিত করা একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের অবদান ১ শতাংশের নিচে, অথচ ভারতে এটি ১১ শতাংশ এবং উন্নত দেশগুলোতে ২০ শতাংশের বেশি। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা দক্ষ ব্যবস্থাপকের অধীন পরিচালিত মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে তাদের ক্ষতির আশঙ্কা কমবে, বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে এবং সর্বোপরি বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের দ্বার উন্মোচিত হবে।’

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ থেকে জানা যায়, পুঁজিবাজারের নেতিবাচক অবস্থার কারণে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমানে সরকারের যুগান্তকারী অর্জন ¤øান হতে বসেছে। বিষয়টি নীতি নির্ধারণী মহল থেকেও অর্থমন্ত্রীকে বলা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংককে আনুষ্ঠানিক চিঠির মাধ্যমে নির্দেশনা প্রদান করলো।