dse lagoআলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে নতুন বিনিয়োগ আসছে। পাশাপাশি আসছে বড় বিনিয়োগ। আর এ বড় বিনিয়োগে নাম লেখাচ্ছেন বিএনপি পন্থী বড় ব্যবসায়ীরা। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের নামে বড় বিনিয়োগ নিয়ে সক্রিয় এখন তারা। কয়েকজন বিএনপি পন্থী বড় ব্যবসায়ী রীতিমতো গ্যাম্বলারের ভুমিকায় নেমেছেন।

তারা আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে পুঁজিবাজার থেকে রাতারাতি টাকা আয় করার মিশনে নেমেছেন। স্বল্প সময়ে বাজার থেকে মুনাফা তুলে নিতে তারা বাজারে সক্রিয় হয়েছেন বলে জানা গেছে। একাধিক সিকিউরিটিজ হাউজের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা যায়, সম্প্রতি লিবরা ইনফিউশনসের শেয়ারের দর বৃদ্ধিতে মালিকপক্ষ সহ কয়েকজন বিএনপি পন্থী বড় ব্যবসায়ী জড়িত ছিলেন। ওষুধ ও রসায়ন খাতের লিবরা ইনফিউশনস ৯ মাসে লোকসান করলেও শেয়ার দর টানা বেড়েই চলেছে। গত ১১ কার্যদিবসে কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে ৮৯ দশমিক ২১ শতাংশ। তবে এই দর বৃদ্ধির পিছনে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই বলে ডিএসই কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে কোম্পানিটি।

সর্বশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানির বর্তমান পিই রেশিও ১৯৬.৬ পয়েন্ট। অর্থ্যাৎ কোম্পানিতে করা বিনিয়োগ ফিরে পেতে সময় লাগবে প্রায় ১৯৭ বছর। সমর্থিত সূত্রে জানা যায়, একটি সিন্ডিকেট চক্রের মাধ্যমে প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দর বৃদ্ধিতে বিএনপিপন্থী বড় ব্যবসায়ীদের হাত রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাজেটের পর হঠাৎ সক্রিয় হয়ে পড়েন সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা। বাজার চাঙ্গা হওয়ার পেছনেও তাদের ভ‚মিকা রয়েছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে একটি বড় সিকিউরিটিজ হাউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুঁজিবাজারে সাধারণত বড় বিনিয়োগ করেন বড় ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি বড় ব্যাংকাররাও বিনিয়োগ করেন। কিন্তু ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের বিনিয়োগ কমে আসছে। এ জায়গা দখল করেছেন একটি বিএনপি পন্থী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চক্র। আর এর সাথে কোম্পানির মালিকপক্ষ জড়িত রয়েছে। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে এনে তারা এখন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছেন। তাদের বিনিয়োগের অঙ্কটাও বেশ বড়।

বতর্মান বাজার বিনিয়োগের জন্য খুবই সম্ভাবনাময়। আর এ সুযোগ নিচ্ছেন ধনী ব্যবসায়ীরা ও সাবেক কয়েকজন আমলারা।
জানা গেছে, পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছেন, এরকম কয়েকজন সাবেক আমলা ও বিএনপি পন্থী ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণে বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শতাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বাজারে সক্রিয় হয়েছেন। তারা মূলত কম মূলধনি শেয়ারে বিনিয়োগ করে শেয়ারের দর বাড়াচ্ছেন।

Page-01.eps-fতাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী, যারা ব্যাংক ও সিকিউরিটি হাউজেরও মালিক। তাদের মাধ্যমেই বাজারে লেনদেন বাড়ছে, বাড়ছে সূচক। স¤প্রতি লিবরা ইনফিউশন, মুন্নু সিরামিকস, মুন্নু স্টার্ফলার, ফার্মা এইড, ওসমানিয়া গ্লাস সহ বেশকিছু দুর্বল প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর বেড়েছে। মাসের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দর বেড়েছে ৮৯ শতাংশ পর্যন্ত। যে কারণে গত এক মাসে ভিন্ন ভিন্ন সময়ের প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে শোকজ করেছে ডিএসই। যার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধিরা। এসব কোম্পানির শেয়ারের দরবৃদ্ধিতেও তাদের হাত ছিল বলে জানা গেছে।

সুত্রে মতে, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বা বিএসইসির পক্ষ থেকে ১১ ধরনের কারসাজির কথা বলা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি অভিনবই বলে জানিয়েছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। কারসাজিগুলো হলো স্বয়ংক্রিয় গ্রাহক বা অটো ক্লায়েন্ট, শটসেল চক্রাকার লেনদেন ইত্যাদি। এসবের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে চক্রাকার লেনদেন। এক্ষেত্রে কারসাজির আওতায় দাম বাড়াতে পরিকল্পিতভাবে একাধিক ব্যক্তির মধ্যে কৃত্রিম লেনদেনের মাধ্যমে দাম প্রভাবিত করে। এসব কারসাজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন সাবেক আমলা সহ ব্যবসায়ীরা।

কোনো ধরনের সংবেদনশীল তথ্য না থাকার পরও লাগামহীন দর বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক মনে করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাই। তাদের অভিমত, ইতোমধ্যে এসব শেয়ার অতি মূল্যায়িত হয়ে গেছে। এসব কোম্পানিতে কারসাজি হচ্ছে বলে তারা অভিমত প্রকাশ করেন।

এদিকে লিবরা ইনফিউশনস ৯ মাসে লোকসান করলেও শেয়ার দর টানা বেড়েই চলেছে। গত ১১ কার্যদিবসে কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে ৮৯ দশমিক ২১ শতাংশ। তবে এই দর বৃদ্ধির পিছনে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই বলে ডিএসই কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে কোম্পানিটি। সর্বশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানির বর্তমান পিই রেশিও ১৯৬.৬ পয়েন্ট। অর্থ্যাৎ কোম্পানিতে করা বিনিয়োগ ফিরে পেতে সময় লাগবে প্রায় ১৯৭ বছর।

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী ১১ কার্যদিবস আগে কোম্পানির শেয়ারটি সর্বশেষ লেনদেন হয় ৫০৫ টাকা দরে। আর আজ বুধবার কোম্পানির শেয়ারটি সর্বশেষ লেনদেন হয় ৯৫৫ টাকা ৫০ পয়সা দরে। আলোচ্য কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ার দর ৮৯.২১ শতাংশ বেড়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ গত ৬ ও ৭ জুন কোম্পানির শেয়ারটির অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি নিয়ে জানতে চাইলে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই বলে জানায় কোম্পানিটি।

কোম্পানির অনুমোদিত মুলধন ১০ কোটি টাকা। আর পরিশোধিত মূলধন ১ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। জুলাই, ১৭ মার্চ,১৭ এই ৯ মাসে কোম্পানির শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ১২ টাকা ৬৫ পয়সা। গত বছরের একই সময়ে ইপিএস ছিল ৪ টাকা ৮৮ পয়সা। আর (জানুয়ারি-মার্চ, ১৮) প্রান্তিকে কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে ১২ টাকা ১৩ পয়সা। আর গত বছরের একই সময়ে ইপিএস ছিল ৪ টাকা ১০ পয়সা।

১৯৯৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি জীবন রক্ষাকারী আইভি বা ইন্ট্রাভেনাস (শিরায় দেওয়া হয়) স্যালাইন, ডায়রিয়া সংক্রান্ত, অস্ত্রোপচার, রক্তপাত, দুর্বলতা এবং সাধারণভাবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সব চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রোডাক্ট উৎপাদন করে কোম্পানিটি। কোম্পানিটির মোট ১২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০টি শেয়ারের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে। বাকি শেয়ারের ১৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছে এবং ৫১ দশমিক ৭১ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে রয়েছে।

৩০ জুন ২০১৭ হিসাব বছর শেষে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয় ৪ টাকা ৮৬ পয়সা। একই সময়ে কোম্পানির শেয়ার প্রতি প্রকৃত সম্পদ মূল্য (এনএভি) হয় ১ হাজার ৫৭৮ টাকা। আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের তিন প্রান্তিকে (জুলাই ২০১৭ হতে মার্চ ২০১৮) কোম্পানিটিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১২.৬৫ টাকা। আগের বছর একই সময়ে শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৪.৮৮ টাকা। কোম্পানিটির মুনাফায় বড় বিপর্যয় দেখা দেয়ার পরও এর শেয়ার দরে এতো বড় উল্লম্ফন ভালো চোখে দেখছেন না বাজার সংশ্লিষ্টরা।

উল্লেখ্য, লিবরা ইনফিউশনের কর্ণধার বিএনপি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। স¤প্রতি তিনি ঋণখেলাপি মামলায় কারাবন্দী হয়ে জামিনে মুক্ত হন। এর আগে তিনি একটি হত্যা মামলার প্রধান হিসাবে দীর্ঘদিন কারাভোগ করেছেন। এসব কারণে কোম্পানিটির ব্যবসা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে বলে কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান।

অন্যদিকে বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীদের কোম্পানি মুন্নু জুট ও মুন্নু স্টাফলারের শেয়ার দাম প্রায় এক মাস ধরে টানা বাড়ছে। গত এক মাসে দুইটি কোম্পানির শেয়ারের দর প্রায় দ্বিগুনের কাছাকাছি। তবে মুন্নু সিরামিকস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শেয়ারের এই দাম বৃদ্ধির পেছনে কোনো কারণ নেই। যে কারণে কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করতে তথ্য প্রকাশ করে ডিএসই। এরপরও কোম্পানিটির শেয়ার দাম বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে।

স্বল্প মূলধন ও রাইট ইস্যুর গুজবে আকাশচুম্বি দরে অবস্থান করছে মুন্নু জুট স্টাফলার্সের শেয়ার দর। যে দরের বিনিয়োগ ফেরত পেতে ৫৬২ বছর লাগবে। এমন ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা কোম্পানিটির শেয়ার দর প্রায় ৩ হাজার ৫ শত টাকা।
মুন্নু জুটের মুনাফা স্বাভাবিক হলেও শেয়ার দর রয়েছে অতি মুনাফা করা কোম্পানিগুলোর সারিতে। বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৪২টি কোম্পানির মধ্যে শেয়ার দরে ২য় অবস্থানে রয়েছে মুন্নু জুট।

১৯৮২ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ মাত্র ৪৬ লাখ টাকা। আর এই স্বল্প মূলধনের কারনে কোম্পানিটির শেয়ারের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি সহজ হয়েছে। তবে সেই দর বৃদ্ধিতে কোম্পানিটির শেয়ার এখন মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকিতে রয়েছে। অন্যদিকে কোম্পানিটির পর্ষদ ৩০০ শতাংশ রাইট শেয়ার দেবে বলে এরইমধ্যে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তথ্য ছড়ানো হয়েছে। তবে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে, এ বিষয়ের সত্যতা পাওয়া যায়নি।