পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার স্বার্থে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের বিকল্প নেই
ফাতিমা জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বর্তমান পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার স্বার্থে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের প্রয়োজন। ব্যাংকে স্থায়ী আমানত বা এফডিআর সুদের হার কমানোয় এ সেক্টরের বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকছেন পুঁজিবাজারের দিকে। গত কয়েক মাস আগেও ব্যাংকগুলোয় স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি এফডিআর রেখে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যেত। এখন সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী পাওয়া যাচ্ছে ৬ শতাংশ।
প্রাপ্ত এ মুনাফা থেকে ব্যাংকের সার্ভিস চার্জ ও সরকারের কর পরিশোধের পর মুনাফা আর থাকছে না। এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হার সমন্বয় করলে মুনাফার অঙ্ক আরও কমে যাচ্ছে। এদিক বিবেচনায় শেয়ার মার্কেট অনেক বেশি লাভজনক। কারণ ছয় শতাংশ সুদে যদি ব্যাংকে আমানত রাখা যায় তাহলে ট্যাক্স কেটে চার-পাঁচ শতাংশ লভ্যাংশ পাওয়া যায়।
আর পুঁজিবাজারে অনেক কোম্পানি ১৫ শতাংশ নগদ বা বোনাস লভ্যাংশ দিচ্ছে, যা ব্যাংকের ডিপোজিট রেটের তুলনায় অনেক বেশি। এমনটা দেখেই পুঁজিবাজারের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলশ্রæতিতে গত কয়েক কার্যদিবস যাবৎ বাজারে লেনদেনে কিছুটা ইতিবাচক প্রবণতা বিরাজ করছিল। সাথে সূচকেও ছিল ইতিবাচক ধারা। মূলত নতুন করে ক্রয় চাপ বাড়াতেই বিনিয়োগকারীরা প্রফিট সংগ্রহ করেছেন বলে ধারনা বাজার সংশ্লিষ্টদের।
গত কয়েকদিনে সূচক অনেকটা বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে মুনাফা সংগ্রহ করা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আর সামনে বাজারের জন্য আরও ভালো ভালো খবর আসছে, যেমন, এক্সপোজার সমাধান, নতুন নতুন ফান্ড, দ্বিতীয় প্রান্তিকের ইপিএস, জুন ক্লোজিংয়ের লভ্যাংশ এবং সর্বপরি চীনা বিনিয়োগ। এসব কিছুই বাজারে একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অতএব এখন বাজার তার স্বাভাবিক গতিতে চলছে। উত্থান-পতন এটা পুঁজিবাজারের চিরাচরিত নিয়ম। তাই গুজবে কান না দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করতে হবে। আর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটা বিষয় সবারই খেয়াল রাখা উচিৎ। সেটা হলো সূচক কোন বিষয় নয়। আসল হলো বিনিয়োগকৃত কোম্পানির সার্বিক অবস্থা। কোম্পানিটি যদি ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন হয়, তাহলে প্রফিট একসময় না একসময় আসবেই। আর সার্বিকদিক বিবেচনায় বর্তমান বাজার অনেকটা স্থিতিশীল বলে ধারনা তাদের।
ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছায়েদুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্য সচেতনতার বিকল্প নেই। কারন পুঁজিবাজার খুবই সংবেদনশীল একটি বাজার। এখানে সফল হতে হলে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করতে হবে। এর জন্য বুঝে-শুনে, সঠিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে সচেতনতার সাথে বিনিয়োগ করতে হবে। তেমনি পুঁজিবাজারে পরিবর্তন হবেই; সেই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। মার্কেটের হঠাৎ উত্থান বা হঠাৎ পতন আমাদের কেউই প্রত্যাশা করে না। তাই গুজবে কান না দিয়ে সঠিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করার আহবান জানান।
বাজার সংশ্লিষ্ট-ব্যক্তিরা বলছেন, আমাদের দেশের অনেক বিনিয়োগকারীর অভিযোগ, প্রত্যাশা অনুযায়ী ডিভিডেন্ড পাচ্ছেন না তারা। একটি কোম্পানি যা আয় করে তার পুরোটাই যে ডিভিডেন্ড দিতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সাধারণত দুভাবে ডিভিডেন্ড দেওয়া হয়। একটি ক্যাশ ডিভিডেন্ড, অন্যটি স্টক ডিভিডেন্ড। এখন কোম্পানির সামনে যদি কোনো প্রকল্প থাকে যেখানে কোম্পানি মনে করছে বিনিয়োগ করলে ভালো প্রফিট আসবে।
তখন তারা ভাবে ব্যাংক থেকে টাকা নিলে নির্ধারিত চার্জ আসবে এবং প্রকল্প থেকে প্রফিটে যেতে দুই-তিন বছর সময় লাগবে কিন্তু নিজস্ব ফান্ড ব্যবহার করলে নির্ধারিত চার্জ থেকে বাঁচা যায়। ফলে কোম্পানি পুরো অর্থ ডিভিডেন্ড হিসেবে না দিয়ে একটি অংশ রেখে দেয়। সেটা ভেবে তারা রিজার্ভে কিছু অর্থ রেখে দেয়।
তাই রিজার্ভে রাখাটি খারাপ কিছু নয়। কিন্তু এর ব্যতিক্রম করলে সেটা নিশ্চয় হঠকরী। তবে আমাদের দেশের অধিকাংশ বিনিয়োগকারী স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ করায় নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই প্রত্যাশিত মুনাফা করতে চাইলে অবশ্যই ভালো কোম্পানিতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে আসা দরকার বলেও মনে করছেন ওই বিশ্লেষকরা।
পুঁজিবাজারের টেকনিক্যাল অ্যানালিস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ মহসীন বলেন, দেশের পুঁজিবাজার একটি গুজবভিত্তিক বাজার। অপ্রমাণিত খবরগুলোকেই মূলত গুজব বলা হয় এবং যা লোকমুখে ছড়ায়। আর গুজবনির্ভরতা বা গুজব পৃথিবীর সব মার্কেটেই থাকে কিন্তু আমাদের দেশে হয়তো এর প্রভাব অনেক বেশি। গুজবের কারণে বাজারে যে ঘটনাগুলো ঘটে এবং এটির যখন সত্যতা প্রমাণ হয়, তখন সেটি আর গুজব থাকে না। সত্য ঘটনায় পরিণত হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কাদের থাকে এই গুজব সংগ্রহ করার ক্ষমতা? যাদের থাকে, তারা কোনো না কোনোভাবে ইনসাইডার। আর ইনসাইডাররা যখন উপকৃত হতে চান, তখন গুজবটি বাজারে ছড়ানোর আগেই তারা অবস্থান নেন। যখন অনেক মানুষকে গুজবে আকৃষ্ট করে টেনে আনা সম্ভব হয়, তখন সেখান থেকে তারা কেটে পড়েন এবং যখন এটি খবর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন দেখা যায় ওই গুজবভিত্তিক শেয়ারটির পতন হয়। যে কারণে বড় এনালিস্টরা বলেছেন, গুজবের সঙ্গে সঙ্গে তোমরা কেন শেয়ার বিক্রি কর। এ কথাটি বিখ্যাত পÐিতদের।
আর যারা জানেন, তারা এ পদ্ধতি অনুসরণ করেন এবং যারা জানেন না, তারা গুজবের সময় অপেক্ষা করেন খবরের সময় ক্রয় করে। কাজেই যারা দক্ষ বিনিয়োগকারী, তারা গুজবের সময় শেয়ার সংগ্রহ করেন এবং সুনিশ্চিত খবরে তারা সেখান থেকে বেরিয়ে পড়েন।
আইসিএবির কাউন্সিল মেম্বার মো. শাহদাৎ হোসেন বলেন, একটি শেয়ারের প্রকৃত মূল্য হচ্ছে তার নিট অ্যাসেট ভ্যালু যা তাই এবং সেটুকুই তার মূল্য হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমান বাজারে প্রতিদিন শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে; ফলে এর মূল্য নির্ভর করে চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। সরবরাহ কম কিন্তু চাহিদা বেড়ে গেলে শেয়ারটির মূল্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেড়ে যায়। উল্টো আবার চাহিদা কম এবং সরবরাহ বেড়ে গেলে একইভাবে শেয়ারদর পড়ে যায়। আর কোনো শেয়ারের চাহিদা তৈরি হওয়া উচিত কোম্পানির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিশ্লেষণের ওপর।
তবে আমাদের এখানে স্বল্প মূলধনি অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ছে। আর স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলোর একটি সীমাবদ্ধতা থাকে। তারা পর্যাপ্ত বা প্রচুর পরিমাণে মার্কেট এক্সপানশন করতে পারে না এবং তাদের পরিমাণ কম থাকে। সে ক্ষেত্রে দেখা যায়, যদি চাহিদা বেশি থাকে, তখন স্বাভাবিকের চেয়ে অস্বাভাবিক পর্যায়ে শেয়ারদর উঠে যায়। আর এ ক্ষেত্রে অবশ্যই নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, যাতে পরবর্তীকালে এমন অবস্থা না হয়।