dseদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা হঠাৎ করে শেয়ার বিক্রি বাড়িয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ বাজার থেকে বিদেশিরা যে পরিমাণ অর্থের শেয়ার ক্রয় করেছেন বিক্রি করছেন তার চেয়ে বেশি। গত তিন মাস (এপ্রিল, মে ও জুন) ধরে এ অবস্থা বিরাজ করছে।

গত তিন বছরে এবারই প্রথম টানা তিন মাস বিদেশিরা ক্রয়ের চেয়ে বেশি অর্থের শেয়ার বিক্রি করলেন। এর আগে ২০১৫ সালের মার্চ, এপ্রিল ও মে- টানা তিন মাস বিদেশিদের ক্রয়ের চেয়ে শেয়ার বিক্রির পরিমাণ ছিল বেশি।

এরও আগে ২০১০ সালের অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর- টানা তিন মাস বিক্রি বেশি ছিল। এছাড়া কখনও বিদেশিরা টানা তিন মাস শেয়ার ক্রয়ের চেয়ে বিক্রি বেশি করেননি।

চলতি বছরে এসে হঠাৎ করে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ান। এ কারণে সার্বিক বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এপ্রিল, মে ও জুন মাসজুড়ে একপ্রকার মন্দার ভেতর দিয়ে গেছে দেশের শেয়ারবাজার। ফলে মূল্য সূচক, বাজার মূলধনসহ সবক্ষেত্রে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা চলতি বছরের এপ্রিলে শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেন। টাকার অঙ্কে এটি দাঁড়ায় ২৪ কোটি ৬৯ লাখ ২৪ হাজার টাকা। পরের মাস মে-তে ২৮২ কোটি ৩৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকা এবং জুনে ২০৬ কোটি ৭১ লাখ ৩৪ হাজার টাকার শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেন বিদেশিরা।

২০১৫ সালের মার্চ, এপ্রিল ও মে- এই তিন মাসে বিদেশিদের শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি ছিল। এর মধ্যে মার্চে ৩২ কোটি ২৯ লাখ ৫৪ হাজার টাকা, এপ্রিলে ৬৭ কোটি এক লাখ ৭৭ হাজার টাকা এবং মে মাসে ৮৭ কোটি ২৮ লাখ পাঁচ হাজার টাকা ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি ছিল।

এ হিসাবে চলতি বছরের এপ্রিল, মে ও জুন- এই তিন মাসে বিদেশিরা ৫১৩ কোটি ৭৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকার শেয়ার বেশি বিক্রি করেন বা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেন। যা ২০১৫ সালের মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে ছিল ১৮৬ কোটি ৫৯ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। সুতারাং ২০১৫ সালের তুলনায় চলতি বছরের টানা তিন মাসে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ ছিল অনেক বেশি।

তবে ২০১০ সালের তুলনায় বিদেশিদের এ বিক্রির চাপ কিছুটা কম। ওই বছরের অক্টোবরে ৬২ কোটি ৫৪ লাখ ৭১ হাজার টাকা, নভেম্বরে ১৫৬ কোটি ৫৩ লাখ ১০ হাজার টাকা এবং ডিসেম্বরে ৪৯৪ কোটি ৬৩ লাখ ১২ হাজার টাকার শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি ছিল বিদেশিদের। অর্থাৎ টানা তিন মাসে বিদেশিরা ৭১৩ কোটি ৭০ লাখ ৯৩ হাজার টাকার শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেন।

বিদেশিরা ২০১০ সালের যে সময় শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ান, সে সময়ই দেশের শেয়ারবাজারে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়। মহাধসে নিঃস্ব হন অসংখ্যা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। ধকল সামলাতে না পেরে ধুকতে থাকে শেয়ারবাজার। দীর্ঘ প্রায় আট বছর পার হয়েছে, এখনও সেই ধকল পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি বিনিয়োগকারীরা।

এ পরিস্থিতে চলতি বছরে এসে আবারও শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়িয়ে দিয়েছেন বিদেশিরা। বিদেশিদের এমন শেয়ার বিক্রির প্রভাবে গত দুই মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৫০০ পয়েন্টের ওপরে। বাজার মূলধন কমেছে ৪২ হাজার কোটি টাকার ওপরে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ যখন আসে বাজারে তখন তারল্য বৃদ্ধি পায় এবং শেয়ারের দাম বাড়ে। এতে লেনদেনও বেশি হয়। আবার বিদেশিরা যখন শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ উঠিয়ে নেন, তখন বাজারে তারল্য হ্রাস পায়। এ কারণে শেয়ারের চাহিদা কমে, দাম কমে এবং লেনদেন হ্রাস পায়।

তিনি বলেন, আমাদের মার্কেটের মতো ছোট মার্কেটে যেকোনো বড় বিনিয়োগ ঢুকলেই ভোলাটাইল (উদ্বায়ী) হয়। বাজারে একটা ক্রাইসিসি তৈরি হয়। এজন্য মার্কেটের সাইজ বাড়াতে হবে। বড় বড় কোম্পানির শেয়ার তালিকাভুক্ত করতে হবে এবং মার্কেটে অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্ট (উপকরণ) নিয়ে আসতে হবে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, বাজার ওঠা-নামার ক্ষেত্রে বিদেশিদের শেয়ার লেনদেনের শক্ত একটি ভূমিকা রয়েছে। বিদেশিরা যখন শেয়ার ক্রয় করেন তখন বাজার ওঠে, আবার বিক্রি করলে বাজার পড়ে যায়। আমাদের অনেক বিনিয়োগকারী আছেন যারা বিদেশিদের লেনদেন ফলো করেন। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীরা। বিদেশিরা যখন বিক্রির চাপ বাড়ান, তখন এসব বিনিয়োগকারীও শেয়ার বিক্রি করে বেরিয়ে যান। ফলে বিক্রির চাপ বেড়ে বাজার নিম্নমুখী হয়।

এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শক্তিশালী হলে এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যেত। বাজার ফল (পতন) করলে দু-একদিনের মধ্যে সমন্বয় হয়ে যেত। সুতরাং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শক্তিশালী হতে হবে এবং তাদেরকে ডে-ট্রেডিং’র ভূমিকা থেকে বের করে আনতে হবে। আইন দিয়ে তাদের শেয়ার বিক্রি বন্ধ করা যাবে না। তবে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে হয় তো এটা করা যেতে পারে।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে মোটা অঙ্কের শেয়ার ক্রয় করেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। মাসটিতে বিদেশিদের শেয়ার ক্রয়ের পরিমাণ ছিল ৬৬৭ কোটি ৪৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। এর বিপরীতে বিক্রি ছিল ৪৮০ কোটি ১৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ বিক্রি থেকে ক্রয় বেশি হয় ১৮৭ কোটি ২৪ লাখ ২৯ হাজার টাকা।

কিন্তু পরের মাসেই বিক্রির চাপ বাড়িয়ে দেন বিদেশিরা। ফেব্রুয়ারিতে ৩৯২ কোটি ৯৯ লাখ দুই হাজার টাকার শেয়ার ক্রয়ের বিপরীতে বিদেশিরা বিক্রি করেন ৪৮৭ কোটি ৭১ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি হয় ৯৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা। যদিও মার্চে এসে আবার শেয়ার ক্রয় বাড়ান বিদেশিরা। মার্চে বিদেশিদের বিক্রির চেয়ে ক্রয় বেশি হয় ১৫৬ কোটি ৭০ লাখ ৩২ হাজার টাকা। তবে এপ্রিল, মে ও জুন- এই তিন মাসে আবার শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ান তারা। এর মাধ্যমে চলতি বছরে শেষ হওয়া ছয় মাসের মধ্যে চার মাসেই বিদেশিরা শেয়ার ক্রয়ের থেকে অতিরিক্ত বিক্রি করেন।

ডিএসইর সাবেক সভাপতি আহসানুল ইসলাম দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আমাদের থেকে বুদ্ধিমান। সবাই ভাবে ওরা বিক্রি করলে বাজার নিশ্চয়ই পড়বে। এছাড়া বিদেশিরা যখন বিক্রি করেন আমাদের মতো খুচরা বিক্রি করেন না। কেনার সময় ওরা বাল্কে (এক সঙ্গে অনেক) কেনেন, আবার বিক্রির সময় বাল্কে বিক্রি করেন। যে কারণে সাপ্লাইটা (সরবরাহ) হঠাৎ করেই বেশি আসে। এসব কারণে ওরা যখন বিক্রি করেন তখন মার্কেটে পতন ঘটে।

বিদেশিদের শেয়ার বিক্রি বাজারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিদেশিরা যে বিক্রিটা করেন সেটা ওয়ান ওয়ে। বিক্রি করে তারা টাকা নিয়ে যান। আবার তাদের দেখে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী শেয়ার ক্রয় করেন, তারাও বিক্রি করে বের হয়ে যান। এসব কারণে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ বাজারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।

ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, বিদেশিরা সাধারণত দুটি দিক খেয়াল রাখেন। প্রথমত, তারা যদি মনে করেন প্রফিট টেক অফ করবেন, তাহলে তারা তা করে ফেলেন। দ্বিতীয়ত, শেয়ারটা যদি ভালো হয় এবং রিজিওনাল প্রাইজ হয় তাহলে তারা কন্টিনিউ করেন।

‘আমার ধারণা, তারা (বিদেশিরা) মনে করছেন বাজারে শেয়ারের দাম ওঠা-নামা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। সুতরাং তারা বাজার থেকে সরে আসাটাই ভালো মনে করছেন। তাদের অ্যাটিচিউড এমনই মনে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, গত তিন মাসে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির যে চাপ ছিল, হয় তো সেই বিক্রির চাপ সামাল দেয়ার মতো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী আমাদের বাজারে নেই। ভারতের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেখানে বিদেশিরা বড় অঙ্কের শেয়ার ধারণ করেন। কিন্তু তারা শেয়ার বিক্রি করলেও বাজারে খুব একটা প্রভাব পড়ে না।

আর আমাদের এখানে যখন বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করেন তখন ক্রেতা থাকে না। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, মিউচ্যুয়াল ফান্ড কারও কোনো ভূমিকা নেই। যে কারণে বাজারের পতন হয়। বিদেশিদের ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর বাজার ওঠা-নামা করে। এটা আমাদের বাজারে অত্যন্ত দুর্বল একটি দিক।