national housingআলমগীর হোসেন ও ফাতিমা জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে চলছে নানা ধরনের ভয়ংকর প্রতারণা। এবার কারসাজির মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার নিয়ে নতুন করে ইনসাইডার ট্রেডিং এর অভিযোগ উঠেছে। তেমনি নতুন করে ইনসাইডার ট্রেডিং’র অভিযোগ ন্যাশনাল হাউজিং বিরেুদ্ধে। আর এ ইনসাইডার ট্রেডিং ও কারসাজির মুল নেপেথ্যে চলছে শীর্ষ এক ব্রোকারেজ হাউজ থেকে। ইতিমধ্যে কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার কারসাজি করে আলোচনার এসেছে ব্রোকারেজ হাউজটি। ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের মতো বিষয়গুলো পুঁজি করে প্রতারণা করে চলছে।

গত বৃহস্পতিবার ন্যাশনাল হাউজিং’র সমাপনী দর ছিল ৫২ টাকা ৯০ পয়সা, যা আগের কার্যদিবসে ছিল ৪৮ টাকা ১০ পয়সা। ঐদিন ৩৯৮ বারে এ কোম্পানির মোট ১৪ লাখ ৮০ হাজার ৫৫৩টি শেয়ার লেনদেন হয়। গত এক বছরে শেয়ারটির সর্বনিম্ন দর ছিল ৩৫ টাকা ২০ পয়সা ও সর্বোচ্চ দর ৫৭ টাকা ৮০ পয়সা।

টানা চার কার্যদিবস ম্যানুপুলেটেড করে শেয়ারের দর বাড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। এতে একশ্রেণীর বিনিয়োগকারী লাভবান হচ্ছেন। তবে লুট হচ্ছে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীর সম্বল। আইন-কানুন কিংবা নজরদারি কোনো কিছু দিয়েই প্রতারকদের লাগাম টানা যাচ্ছে না।

এদিকে এবার ইনসাইডার ট্রেডিং’র অভিযোগে পুঁজিবাজারে কারসাজির রোধে সরকারের নির্দেশে ‘সার্বক্ষণিক যৌথ ইন্সপেকশন দল’ নামে একটি কমিটি মাঠে নেমেছে। বাজার তদারকির লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়ে এবার তারা মাঠে নামছে।

পুঁজিবাজারে ২০১০ সালের মহাধসের পরিপ্রেক্ষিতে ইব্রাহীম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে সার্বক্ষণিক যৌথ ইন্সপেকশন দল গঠন করা হয়। বিশেষ করে ধস পরবর্তী পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে এবং বাজারকে কেউ যাতে মেনুপুলেট করতে না পারে সে জন্যই এ দল গঠন করা।

কিন্তু দল গঠন করা হলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তা আস্থা যোগাতে পারেনি। ২০১২ সালের ৩ জানুয়ারি সার্বক্ষণিক যৌথ ইন্সপেকশন দলের সদস্যদের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। পাশাপাশি ওই গেজেটে দলটির কার্যপ্রণালীর বর্ণনা দেওয়া হয়।

সা¤প্রতিক বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে না হতে ফের কারসাজি চক্র সক্রিয় রয়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি বলছে তাদের শেয়ারের দর বাড়ার পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। অথচ ওই কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়ছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। এ তালিকায় এমন কোম্পানিও আছে যেগুলো বছরের পর বছর লোকসান গুনছে।

বাজার বিশ্লেষকরা এমন অবস্থাকে ইনসাইডার ট্রেডিং বা কারসাজি করে শেয়ারের দাম বৃদ্ধি বলে অভিহিত করেছেন, যার সর্বশেষ ক্ষতির শিকার হন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

ডিএসইর সাবেক প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে জানান, পুঁজিবাজারে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে শেয়ারের দাম বাড়ানো বা ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে আইনগত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পুঁজিবাজারে কারা এ ধরনের কার্যক্রম চালায় তা চিহ্নিত করা কঠিন। যদি তা চিহ্নিত করা সম্ভব হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিধান রয়েছে। আর সময় সময় যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে সেসব কোম্পানিকে কেন দাম বাড়ছে কারণ জানতে চেয়ে নোটিশ করা হচ্ছে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক দেবব্রত কুমার সরকার জানান, পুঁজিবাজারের এমন অবস্থা প্রায়ই হয়ে থাকে। মূলত যখন পুঁজিবাজার ভালো অবস্থায় থাকে তখন এটি সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এটিকে ইনসাইডার ট্রেডিং হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ইনসাইডার ট্রেডিং হচ্ছে কোম্পানির কোনো গোপন খবর পুঁজিবাজারে প্রকাশ না করে নিজেদের মধ্যে লেনদেন করা কিংবা কোম্পানির এমন কোনো খবর যা কোম্পানির জন্য ইতিবাচক তা আগাম বাজারে প্রচার করা।

তালিকাভুক্ত কোম্পানির যে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রথমে ডিএসইর ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের অবহিত করার বিধান রয়েছে। সেটি না করে প্রথমে তা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে প্রচার করে তারা সিংহভাগ শেয়ার ক্রয় করে। তারপর তা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে ডিএসইতে প্রচার করা হয়। তখন সেই তথ্যে আকৃষ্ট হয়ে যখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ক্রয় করতে থাকেন তখন বেশি দামে সিন্ডিকেট সেগুলো বিক্রি করতে থাকে।

তিনি বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের তথ্য প্রকাশ না করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মুনাফা বা লভ্যাংশের বড় অংশ গ্রহণের সুযোগ করে দেয়া হয়, যা আইনগতভাবে সম্পূর্ণ অবৈধ।

আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ খান দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, গত সাত বছর আগে ধসের পর বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু সংস্কার আনা হলেও সুবিধাভোগী লেনদেন বা ইনসাইডার ট্রেডিং বন্ধে কঠোর আইন না থাকায় আস্থার সংকট কাটেনি বিনিয়োগকারীদের। এই ইনসাইডারদের তথ্যের ভিত্তিতে পুঁজিবাজারে অনেক অনিয়ম হয়। এ বিষয়ে আইন থাকলেও তা অত্যন্ত দুর্বল; এ আইনের মাধ্যমে ইনসাইডারদের চার্জশিটের আওতায় আনা যায় না।”

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরের উদাহরণ অনুসরণ করে বাংলাদেশে ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’ বন্ধে আরও কঠোর আইন করার ওপর জোর দেন আরিফ খান। “আমাদের আইনটাকে ব্যাপক পরিবর্তন করে ইনসাইডার ট্রেডিং যারা করে, তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এগুলো করলে পুঁজিবাজারের উপর সাধারন মানুষের আস্থা আরও বাড়বে।”

এদিকে গত চার কার্যদিবসে ন্যাশনাল হাউজিংয়ের দর বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গত সোমবার থেকে ডিএসইতে ন্যাশনাল হাউজিং শেয়ারের দর বাড়ছে। চার কার্যদিবসের ব্যবধানে এর দর ৩৯ থেকে প্রায় ৫৩ টাকায় উন্নীত হয়েছে।

বৃহস্পতিবার সমাপনী দর ছিল ৫২ টাকা ৯০ পয়সা, যা আগের কার্যদিবসে ছিল ৪৮ টাকা ১০ পয়সা। এদিন ৩৯৮ বারে এ কোম্পানির মোট ১৪ লাখ ৮০ হাজার ৫৫৩টি শেয়ার লেনদেন হয়। গত এক বছরে শেয়ারটির সর্বনিম্ন দর ছিল ৩৫ টাকা ২০ পয়সা ও সর্বোচ্চ দর ৫৭ টাকা ৮০ পয়সা।

সর্বশেষ রেটিং অনুযায়ী, ঋণমান দীর্ঘমেয়াদে ‘এ ওয়ান’ ও স্বল্পমেয়াদে ‘এসটি-টু’। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ সমাপ্ত হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন ও অন্যান্য তথ্যের ভিত্তিতে এ মূল্যায়ন করেছে ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি অব বাংলাদেশ (সিআরএবি)।
চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ১ টাকা ১১ পয়সা,

আগের বছর একই সময়ে যা ছিল ১ টাকা ২৬ পয়সা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে এনএইচএফআইএলের ইপিএস হয়েছে ৬৩ পয়সা পয়সা, আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৭০ পয়সা। ৩০ জুন কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ১৫ টাকা ১৯ পয়সা।

২০১৭ হিসাব বছরে শেয়ারহোল্ডারদের ১৯ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে ন্যাশনাল হাউজিং। গেল বছরে কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে ২ টাকা ৪০ পয়সা। ৩১ ডিসেম্বর কোম্পানির এনএভিপিএস দাঁড়ায় ১৫ টাকা ৯৮ পয়সায়। ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত হিসাব বছরের জন্য ১৮ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয় ন্যাশনাল হাউজিং। সে হিসাব বছরে প্রতিষ্ঠানটির ইপিএস হয়েছে ২ টাকা ২৯ পয়সা। ২০১৫ হিসাব বছরের জন্য ১৭ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ পেয়েছেন ন্যাশনাল হাউজিংয়ের শেয়ারহোল্ডাররা।

২০০৯ সালে তালিকাভুক্ত ন্যাশনাল হাউজিংয়ের অনুমোদিত মূলধন ২০০ কোটি ও পরিশোধিত মূলধন ১০৬ কোটি ৩৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। রিজার্ভ ৬৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। কোম্পানির মোট শেয়ার সংখ্যা ১০ কোটি ৬৩ লাখ ৯২ হাজার। এর মধ্যে ৬০ দশমিক ৬৮ শতাংশ এর উদ্যোক্তা-পরিচালকদের কাছে,

সরকার ৯ দশমিক ৩৪, প্রতিষ্ঠান ১৮ দশমিক ৮১ ও বাকি ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। সর্বশেষ বার্ষিক ইপিএস ও বাজারদরের ভিত্তিতে শেয়ারটির মূল্য-আয় অনুপাত বা পিই রেশিও ২২ দশমিক শূন্য ৪; অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যা ২৩ দশমিক ৮৩।

দ্বিতীয় পর্ব দেখতে চোখ রাখুন