dseআলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সর্বশেষ ৬৫৩তম সভা বসে গত সোমবার। সভায় বেশ কিছু ব্রোকারেজ হাউস, কোম্পানি এবং ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট সংস্থাকে জরিমানা ও সতর্ক করা হয়। এছাড়াও তালিকাভুক্ত ২০টি কোম্পানির রিজার্ভ নেগেটিভ থাকার পরও শেয়ার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএসইসির নমনীয় আচরণের কারণে এসব সতর্কতা কার্যত পুঁজিবাজারে কারসাজি বন্ধে খুব একটা ভ‚মিকা রাখতে পারছে না। বাজার চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০ সালের বড় ধরনের ধসের অন্যতম কারণ ছিল কারসাজি। এরপরে গত আট বছরে শেয়ারবাজারে ব্যাপক সংস্কার সত্তে¡ও কারসাজি বন্ধ হয়নি। একশ্রেণির অসাধু বিনিয়োগকারী কারসাজির আশ্রয় নিয়ে লাভবান হচ্ছেন। এর শিকার হয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বারবার পুঁজি হারাচ্ছেন। ধসের পর এত দীর্ঘ সময়েও শেয়ারবাজার যে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না, তার বড় কারণ এটি।

কারসাজি প্রতিরোধে নিয়ন্ত্রক সংস্থার শিথিলতাকে দায়ী করেছেন অনেকেই। স¤প্রতি বাজার অনুসন্ধানে দেখা যায়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ২০টি কোম্পানির রিজার্ভ নেগেটিভ। নেগেটিভ রিজার্ভের কোম্পানি হিসাবে কোম্পানিগুলোর সম্পদ মূল্যও নেগেটিভ। অর্থাৎ কোম্পানিগুলোর নিজস্ব সম্পদ বলতে কিছু নেই। কোম্পানিগুলো কোনো রকমে ধারকর্জে চলছে। অথচ এসব কোম্পানির শেয়ার মূল্য লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে।

বিএসইসির অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির তালিকায় যেসব কোম্পানির নাম এসেছে তার মধ্যে ‘বিডি অটোকার’ অন্যতম। এই কোম্পানির শেয়ার দর তিন মাসের ব্যবধানে ১২০ টাকার শেয়ার এখন এক হাজার ৪১০ টাকায় হাতবদল হচ্ছে। যার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই বলে বিএসইসিকে জানিয়েছে কোম্পানিটি। অভিযোগ উঠেছে কোম্পানিটির এমডি ও সিইও নেতৃত্বে কারসাজি চলছে। আর মূল হোতা হিসেবে কাজ করছে এক ব্রোকারেজ হাউসের এডিপি।

তিনি বর্তমানে পুঁজিবাজারে কারসাজির মুল হোতা। একইভাবে মুন্নু জুট স্ট্যাফলার্স, মুন্নু সিরামিকস, আজিজ পাইপস, লিগ্যাসি ফুটওয়ার, ফার্মা এইডসের শেয়ার লাগামহীনভাবে দর বাড়ছে। এসব কোম্পানির শেয়ার দর এভাবে বাড়াকে অস্বাভাবিক বলে এর কারণ জানতে চেয়ে নোটিস দেয় ডিএসই।

কিন্তু ডিএসইর নোটিসের জবাবে গত ২৫ জুলাই কোম্পানিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শেয়ার দর এভাবে বাড়ার জন্য তাদের কাছে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তার পরও নিয়ন্ত্রণহীন কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর।

জানা যায়, যেসব কোম্পানি নিয়ে কারসাজির অভিযোগ রয়েছে, সবগুলোরই শেয়ার সংখ্যা কম। এর মধ্যে স্টাইলক্র্যাফটের ৯ লাখ ৯০ হাজার, ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টসের ৯ লাখ ৯৪ হাজার, লিবরা ইনফিউশনের ১২ লাখ ৫২ হাজার, মডার্ন ডায়িংয়ের ১৩ লাখ ৬৮ হাজার, সাভার রিফ্র্যাক্টরিজের ১৩ লাখ ৯৩ হাজার, জুট স্পিনার্সের ১৭ লাখ, রেনউইক যজ্ঞেশ্বরের ২০ লাখ,

নর্দান জুটের ২১ লাখ ৪৩ হাজার, অ্যাম্বি ফার্মার ২৪ লাখ, সোনালি আঁশের ২৭ লাখ ১২ হাজার, ফার্মা এইডের ৩১ লাখ ২০ হাজার, জেমিনি সি ফুডের ৩৭ লাখ ১৩ হাজার, বিডি অটোকারসের ৩৮ লাখ ৬৩ হাজার, রেকিট বিনকিজারের ৪৭ লাখ ২৫ হাজার, কে অ্যান্ড কিউর ৪৯ লাখ তিন হাজার, শ্যামপুর সুগারের ৫০ লাখ, আজিজ পাইপের ৫০ লাখ ৯৩ হাজার।

এ বিষয়ে শেয়ার লেনদেন তদারকির দায়িত্বে থাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এবং শীর্ষ মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তারা জানান, ২০১০ সাল পর্যন্ত শেয়ার কারসাজি হতো ব্যাপকভাবে। এখনো বাজারে ওই প্রবণতা রয়েছে। তবে আগের তুলনায় কমেছে। শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে অনেক দুর্বল কোম্পানির দর হু হু করে বাড়িয়ে এক পর্যায়ে মুনাফা নিয়ে সটকে পড়ছে কারসাজির সঙ্গে জড়িত চক্র। এতে করে কিছু লোক লাভবান হলেও ক্ষতি হচ্ছে বাজারের।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ড. আবু আহমেদ বলেন, ‘পুঁজিবাজারে যারা কারসাজি করে, তাদের নজর থাকে স্বল্প মূলধনী ও কম শেয়ার রয়েছে এমন কোম্পানির দিকে। কারণ এসব কোম্পানি অপেক্ষাকৃত কম পুঁজি নিয়ে তারা গেম করতে পারে। আর তাদের ফাঁদে পা দেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। সর্বশেষ তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ ব্যাপারে বিএসইসির আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে।’

অপরদিকে বিষয়টি জানতে বিএসইসিতে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কিছু কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হচ্ছে মাঝেমধ্যে। বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। দ্রæত এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

এছাড়া ইউনিক শেয়ার ম্যানেজমেন্ট, এবি এন্ড কোম্পানি এবং এলায়েন্স সিকিউরিটিজসহ কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউস আমরা সতর্ক করে চিঠি দিয়েছি। কেয়া কসমেটিকসকে জরিমানা করেছি। এমনকি আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টকেও সতর্ক করা হয়েছে।

তবে এ বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু জরিমানা করা ছাড়া কারসাজির বড় হোতাদের অনেক ক্ষেত্রে আইনের মুখোমুখি করতে পারেনি সংস্থাটি। কারণ ঘটনার নেপথ্যে প্রভাবশালীরা।

প্রতিবেশী ভারতের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা কারসাজির ঘটনায় সে দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীকে জেলে দিয়েছে। আমাদের দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ভয় পায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শেয়ার কারসাজি বেশি। এ ক্ষেত্রে ইনসাইডার ট্রেডিংটাই মুখ্য ভ‚মিকা রাখে।’ মূল্যবোধের অবক্ষয়কে এ ক্ষেত্রে প্রধান কারণ মনে করেন তিনি।

বিএসইসির সাবেক এ চেয়ারম্যান বলেন, ‘কোনো কোম্পানির মুনাফা বা ব্যবসাসংক্রান্ত তথ্য দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও গোপন রাখেন না। এদের অনেকেই বেনামে শেয়ার ব্যবসা করেন।’

বিএসইসির কমিশনের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান দাবি করেন, কোনো শেয়ার লেনদেনে কারসাজি হচ্ছে এমন সন্দেহ হলে তা তদন্ত করে দেখা হয়। তার মতে, কোনো শেয়ারের দর বাড়লেই তাতে কারসাজি হয়েছে- এমন ভাবার যৌক্তিক কারণ নেই।

তিনি আরও বলেন, বিএসইসির কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাও চলছে। রাতারাতি সব কিছুর পরিবর্তন সম্ভব নয়। কারসাজির তদন্তে বিলম্বের বিষয়ে তিনি বলেন, সব আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কিছুটা দেরি হতে পারে। আবার সব তদন্তে যে অপরাধের ঘটনা প্রমাণ করা যায়, তা নয়। আইনের বাইরে গিয়ে কমিশনের কিছু করার নেই।