Saving-money-মোবারক হোসেন , দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: মূলত তিনটি কারণে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছিল সঞ্চয়পত্র বিক্রি। প্রথমত, ব্যাংকগুলোতে মেয়াদি আমানতের বিপরীতে প্রদেয় সুদের হার উল্লেখযোগ্য ভাবে কমছে। ব্যাংকিং খাতে তারল্য উদ্বৃত্তের কারণেও কমেছে সুদের হার। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বলা হয়, শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগের অনুক‚ল পরিবেশের অভাব। যে কারণে সঞ্চয় বিনিয়োগকারীরা উত্তম বিকল্প হিসেবে আকর্ষণীয় ও ঝুঁকিমুক্ত সঞ্চয় স্কিমকেই বেছে নিচ্ছেন।

সর্বশেষ কারণ হিসেবে বিদ্যমান কর নীতিতে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে কর রেয়াত সুবিধা প্রাপ্যকে উল্লেখ্য করা হয়। উল্লিখিত কারণে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক ও পুঁজিবাজার ছেড়ে সঞ্চয়পত্রমুখী হন। কিন্তু এবার প্রত্যাহার হচ্ছে সঞ্চয়পত্রের ওপর আয়কর রেয়াত সুবিধা। এর ফলে এ খাতে বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য মোট লভ্যাংশ থেকে ১৫ শতাংশ আয়কর কেটে নেওয়া হবে। সঙ্গত কারণে তাদের নিট মুনাফা এ হারে কমে যাবে।

স¤প্রতি অনুষ্ঠিত সরকারের ‘নগদ ও ঋণ’ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সুবিধাটি পর্যালোচনা করে যৌক্তিক পদক্ষেপ নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ইতিমধ্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ওই বৈঠকে সঞ্চয়পত্রের ডাটাবেজে টিআইএন অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনাও দেয়া হয়, যা বাস্তবায়ন করবে জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতর। এর ফলে এটি কার্যকর হলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে কিছুটা ভাটা পড়তে পারে। বিপরীতে বিনিয়োগকারীরা এর চেয়ে ঝুঁকিমুক্ত বেশি মুনাফার পথ তালাশ করবে। তবে যারা সাধারণত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন তাদের শিগগির ব্যাংকমুখী করা সম্ভব হবে না- এমনটিই বলছেন এ খাতের বিশ্লেষকরা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরী বলেন, অস্বাভাবিক হারে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বৃদ্ধিতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি এর প্রভাব পড়বে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি হলে আমানতকারীরা ব্যাংকমুখী হবেন না। এতে ব্যাংকের আমানত কমবে। এর ফলে ব্যাংক ঋণ দেয়ার ক্ষমতা হারাবে। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে বেসরকারি খাতের ওপর। আর সরকার বেশি সুদে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ করায় ঋণভার বাড়বে, যার ফলে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকছে।

জানা গেছে, অর্থ সচিব (সদ্য বিদায়ী) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরীর সভাপতিত্বে স¤প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে সরকারের ‘নগদ ও ঋণ’ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে হিসাব মহানিয়ন্ত্রক আবুল ফজলে মো. আবিদ, জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের ডিজি সামছুন্নাহার, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জালাল, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য (করনীতি) কানন কুমার রায় প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার অধিক হারে টাকা নেয়ায় দেশের আর্থিক খাতে বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কা করা হয়।

এ ছাড়া প্রাইমারি ডিলার ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি এবং সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদের কারণে সরকারি ঋণের ঝুঁকিও বাড়ছে। বৈঠকে এ মতামতও উঠে আসে। বৈঠকে উপস্থাপিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ ৫ বছর। কিন্তু ট্রেজারি বন্ডের মেয়াদ ২-২০ বছর। সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কম ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গ্রহণের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত স্বল্পমেয়াদি (সঞ্চয়পত্র) অধিক মাত্রায় ঋণ গ্রহণ করা হচ্ছে।

ফলে সরকারের ঋণ পোর্টফোলিওতে ঝুঁকি ও ব্যয় বাড়ছে। স¤প্রতি পরিস্থিতি এমন আকার ধারণ করেছে যে, কম সুদ ব্যয়সম্পন্ন ট্রেজারি সিকিউরিটিজের মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ করা হচ্ছে না। বরং বেশি পরিমাণে সুদ পরিশোধ করে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে। এতে সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনার মূলনীতিও ব্যাহত হচ্ছে বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে।

অপরদিকে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি অর্থ সঞ্চয়পত্র খাত থেকে আসায় সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে কম ঋণ নিচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে উল্টো বকেয়া ঋণের ১০ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ওই বৈঠকে সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনা ঝুঁকি এবং ব্যয় হ্রাসের লক্ষ্যে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের বিপরীতে আয়কর রেয়াত সুবিধা পর্যালোচনা করতে বলা হয় এনবিআরকে। পাশাপাশি এটি পর্যালোচনা করে যৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতেও বলা হয়। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীদের মুনাফা কিছুটা কমবে।

উল্লেখ্য, বর্তমানে একজন ব্যক্তি আয়ের ২৫ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারেন সঞ্চয়পত্রে। মোট বিনিয়োগের ১৫ শতাংশ পর্যন্ত আয়কর রেয়াত সুবিধা দেয়া হয়। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে একজন বিনিয়োগকারী মোট ৫ হাজার টাকা মুনাফা পেলে সেখান থেকে ১৫ শতাংশ আয়কর কেটে রাখা হবে।

প্রসঙ্গত, সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রস্তুতকৃত সরকারের একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বিগত পাঁচ বছরে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ঋণ নেয়ার হার ৩৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৬ শতাংশে উন্নীত হয়। একই সময়ে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়ার হার ৬৬ শতাংশ থেকে ৪৪ শতাংশে নেমেছে। পর্যালোচনা প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, বিগত পাঁচ বছরে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ঋণ নেয়ার হার বেড়েছে ২২ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংকিং খাত থেকেও ২২ শতাংশ ঋণ নেয়ার হার কমেছে।

এদিকে সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ গ্রহণের কারণে এ খাতে সুদ পরিশোধের ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ৪০ হাজার ৬৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। একই সময়ে সরকার এ ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধ করেছে ১৬ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ঋণ নেয় ১২ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা।