DSEসাজিদ খান ও আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: তিন ইস্যুতে টানা দরপতনের বৃত্তে আটকা পড়েছে দেশের পুঁজিবাজার। এর মধ্যে মাঝে মাঝে সূচকের উকি মারলেও তা স্থায়ী হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে নানামুখী উদ্যোগ নিলেও কার্যত কোনো ফল দৃশ্যমান হচ্ছে না। বাজার কখনো একটানা ঊর্ধ্বমুখী আবার কখনো ক্রমাগত নিম্নমুখী।

তাছাড়া বিএসইসির ২৫ বছর পুর্তিতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সবার প্রত্যাশা ছিল বাজার ভাল হবে। তবে আজ দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাছাড়া চীনা কনসোর্টিয়াম ঘিরে বিনিয়োগকারীদের ফিকে হওয়া প্রত্যাশা উত্তাপ ছড়িয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর আগমন নিয়ে। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের সেই প্রত্যাশা ধরে রাখতে পারলেন না বাজার ভালো করার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও।

যদিও পুঁজিবাজারে তাকে স্বাগত জানাতে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন বাড়ানো হয়েছিল আধা ঘন্টা। এমনটা দেখে অনেকেই ধারনা করেছিলেন বাজারে বুধবার কিছু হতে যাচ্ছে। হয়তবা প্রধানমন্ত্রী বিনিয়োগকারীর শূন্য হাতদুটো প্রত্যাশা দিয়ে ভরিয়ে দিবেন।

কিন্তু সরকার প্রধানের গতানুগতিক বক্তব্যে তাদের সে প্রত্যাশা গুড়েবালিতে পরিণত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে পুঁজিবাজারে দর পতন ঘটেছে এবং মৌলভিত্তি সম্পন্ন অনেক শেয়ারের দরই আরো তলানিতে ঠেকেছে।

যদিও অনেকে আবার প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। কেননা তিনি বাজার উন্নয়নে ও বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় বেশ কিছু সুপারিশ করেছেন। পাশাপাশি পুঁজিবাজার হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের দীর্ঘ মেয়াদী অর্থায়নের নির্ভরযোগ্য উৎস, এখানে বিনিয়োগ করে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হোক তা সরকার চান না বলেও জানিয়েছেন। যা বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশ বাড়াতে পারত। কিন্তু সেটা না হয়ে উল্টো চিত্র হওয়ায় দেখা দিয়েছে সংশয়। তাহলে কোন চক্র কারসাজির মাধ্যমে শেয়ার হাতানোর লক্ষ্যে পুঁজিবাজারকে কি তাদের নির্ধারিত চক্রেই রাখছে? এমন প্রশ্ন থেকেই যায়!

এদিকে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে সংশ্লিষ্টরা নানামুখী উদ্যোগ নিলেও কার্যত কোনো ফল দৃশ্যমান হচ্ছে না। বাজার কখনো একটানা ঊর্ধ্বমুখী আবার কখনো ক্রমাগত নিম্নমুখী। সম্প্রতি কয়েক দফা ধাক্কায় টালমাটাল অবস্থায় এখন পুঁজিবাজার। সূচক কমার সঙ্গে কমছে লেনদেন। প্রতিদিন বাজার মূলধন কমছে। আর শেয়ার বিক্রির চাপে কোম্পানির শেয়ার দামও কমছে। অস্বাভাবিক উত্থান-পতনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারী, রক্তক্ষরণ বাড়ছে তাঁদের।

বাজার সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে বলেছে, ব্যাংক, পোটফলিও ম্যানেজমেন্ট ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারকে বরং নেতিবাচক অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অব্যাহত পতনের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করে লোকসানের পাল্লা ভারি করছেন। অন্যদিকে, সরকারের দায়িত্বশীল রেগুলেটেড প্রতিষ্ঠানের কঠোর কিছু পদক্ষেপ বাজারকে কারসাজি চক্রের ফায়দা হাসিলে ভুমিকা রাখছে বলেও মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা বলছেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা হচ্ছে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী বছরে পুঁজিবাজার একটা ভাল অবস্থানে নিয়ে আসবে। তবে বিনিয়োগকারীদের সে আশায় গুড়োবালি। ফলে বাজারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছেন বিনিয়োগকারীরা।

অন্যদিকে সার্বিকভাবে দেশ উন্নয়নে দিকে এগিয়ে যাচেছ। গত কয়েক বছরে সব সূচকের উন্নতির সঙ্গে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দ্বিগুণ হয়েছে। বেড়েছ মোট জাতীয় আয়ও (জিএনআই)। তবে জিডিপির উন্নয়নের সঙ্গে সমানতালে এগোয়নি পুঁজিবাজার। অর্থনীতির আকার বাড়লেও অনেকটা পেছন পানে হাঁটছে ২৬ লাখের বেশি বিনিয়োগকারীর পুঁজিবাজার।

অনেকে পুঁজিবাজার থেকে মুখও ফিরিয়ে নিচ্ছে। অনেক সময় শেয়ারবাজার ইতিবাচক ধারায় ফেরার চেষ্টা করলে এই বিনিয়োগকারীরা ফিরে এসে কয়েক দিনের মধ্যে আবার হতাশ হয়ে ফিরে যায়। এই আস্থার অভাবেই পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা আসছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বর্তমান বাজার গতিশীল করতে আইনকানুন ও নিয়মে পরিবর্তন এলেও কমছে কোম্পানির তালিকাভুক্তির হার। ফলে পুরনো কোম্পানি কিংবা বছর বছর লভ্যাংশ না দেওয়া দুর্বল ভিত্তির কোম্পানিতে ভরসা করতে হচ্ছে বিনিয়োগকারীকে। আর এটি কাজে লাগিয়ে মিথ্যা তথ্য কিংবা গুজব ছড়িয়ে শেয়ার দামে হ্রাস-বৃদ্ধি করে ফয়দা লুটছে কারসাজিচক্র। মুনাফার জন্য বিনিয়োগ করলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র ও সাধারণ বিনিয়োগকারী।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, জিডিপির আকারের সঙ্গে বাজার মূলধনের তুলনা করে পুঁজিবাজারের শক্তি নির্ণয় করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীনের মতো উন্নত দেশের পুঁজিবাজার জিডিপির আকারের চেয়ে বহুগুণ বেশি হলেও বাংলাদেশের বাজার অনেক নিচুতে। ২০১০ সাল থেকে জিডিপি ও বাজার মূলধনের অনুপাত ধারাবাহিকভাবেই কমছে। বছর বছর জিডিপির আকার বাড়লেও বাড়ছে না পুঁজিবাজারের মূলধন।

বাজার বড় না হওয়ার পেছনে ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তি না হওয়াকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে দেশের পুঁজিবাজারের মূলধন জিডিপির আকারের মাত্র ১৭.১৯ শতাংশ। ২০১৭ সালেও এই হার ছিল ১৮.৪৬ শতাংশ। ২০১০ সালের পর থেকে গত ছয় বছরে ধারাবাহিকভাবে কমেছে বাজার মূলধন ও জিডিপির অনুপাত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিকিউরিটিজ হাউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী নামধারী এক শ্রেনীর অসাধু মহল বিভিন্ন গুজবের মাধ্যমে বাজারকে প্রভাবিত করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে। এ কারণে বাজারে স্থায়ী স্থিতিশীলতা ফিরে আসছে না। কাজেই তিনি বিনিয়োগকারীদেরকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানান।

তেমনি বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নির্ভর করে থাকে সাধারণত ব্যাংক খাতের ওপর। এ খাতের কোম্পানির শেয়ার দর কমা থাকায় অনেকেই এর প্রতি আগ্রহ থাকেন। কিন্তু ব্যাংকগুলো ডিসেম্বর ক্লোজিং হয়েছে সামনেই ব্যাংকগুলো তাদের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে লভ্যাংশ ঘোষণা করবে। তাই বিনিয়োগকারীরা যারা মুনাফায় আছে তারা অপেক্ষা করছে ব্যাংকগুলোর ডিভিডেন্ড ঘোষণার উপর। তাই এ খাতে অনেকটাই ধীর গতি দেখা গেছে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারকে কার্যকর করতে কিংবা যথাযথভাবে গড়তে নতুন নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে হবে। মৌল ভিত্তির কোম্পানি বাজারে এলে বিনিয়োগকারীও আকৃষ্ট হবে। গতিশীল ও কার্যকর বাজার গড়ে তুলতে কোম্পানির সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। যদিও একটি তালিকাভুক্তিতে অনেক সময় ও জটিলতা রয়েছে। বাজারে বহুজাতিক ও সরকারি কোম্পানি আনা খুব জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক উসমান ইমাম বলেন, ‘বাইরের কোনো কোনো দেশের পুঁজিবাজার জিডিপির চেয়েও বহুগুণ বেশি। আমাদের পশ্চাদ্গতির কারণ হচ্ছে সরকারি ও বহুজাতিক কোম্পানিকে বাজারে নিয়ে আসতে না পারা। বহুজাতিক কোম্পানিকে বুঝিয়ে কিংবা ব্যবসা পরিচালনায় শর্ত দিয়েই বাজারে আনতে হবে। কোনো দেশেই বহুজাতিক কোম্পানি সহজে তালিকাভুক্ত হয় না।

নিয়মনীতির মাধ্যমে কিংবা প্রণোদনা দিয়ে আনতে হয়। নিজেদের স্বার্থে প্রণোদনা দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিকে বাজারে আনতে হবে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ইকুয়িটিনির্ভর না হয়ে বন্ড কিংবা অন্যান্য পণ্যও আনতে হবে। জনগণকে বিনিয়োগমুখী করতে হলে বিভিন্নতা আনতে হবে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, ‘শেয়ার না থাকলে বিনিয়োগ আসবে না। যদি জোগান না বাড়িয়ে চাহিদা সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে সেটি হবে না। বিনিয়োগকারীকে বাজারে ডাকার আগে শেয়ারের সরবরাহ বাড়ানো প্রয়োজন। এতে নতুন নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্তি খুবই জরুরি। বাজারকে গতিশীল করতে গভীরতা বাড়াতে হবে। বহুজাতিক ও সরকারি কোম্পানিকেও বাজারে আনতে হবে।’