DSEসাজিদ খান ও আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: কৌশলগত অংশীদার হিসেবে চীনা জোটের কাছে এক-চতুর্থাংশ শেয়ার বিক্রির সম্পূর্ণ অর্থই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সদস্যরা। মূলধনী কম্পানির ওপর করহার ১৫ থেকে ৫ শতাংশ করার ঘোষণার পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

কর কমানোয় আগামী তিন বছর পর্যন্ত চীনা জোট থেকে পাওয়া ৯৪৭ কোটি টাকা পুঁজিবাজারেই বিনিয়োগ করবেন তাঁরা। এর ফলে পুঁজিবাজারে নতুন বিনিয়োগ ঢুকতে যাচ্ছে। এতে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

গত ১২ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী চীনা কনসোর্টিয়াম থেকে প্রাপ্ত অর্থে কর সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ডিএসই ও ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশন থেকে চীনা কনসোর্টিয়ামের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থের ক্ষেত্রে ক্যাপিটাল গেইন টেক্স মওকুফের জন্য আবেদন করা হয়। পুঁজিবাজারের সার্বিক দিক বিবেচনা করে তাদেরকে কর সুবিধা দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে ওই অর্থ পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে ৩ বছরের জন্য বিনিয়োগের শর্ত দেন তিনি। তাহলে ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশ গেইন টেক্স চার্জ করা হবে।

অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ি, চীনা কনসোর্টিয়ামের থেকে প্রাপ্ত ৯৪৭ কোটি টাকার উপর ৫ শতাংশ হারে ৪৭ কোটি টাকার কেপিটাল গেইন টেক্স দিতে হবে। আর বাকি ৯০০ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে হবে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) রজত জয়ন্তীতে গত বুধবার সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শর্তসাপেক্ষে গেইন ট্যাক্স ছাড় দেওয়ার ঘোষণা দেন।

বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গেইন ট্যাক্সে ১০ শতাংশ করছাড় পেলে প্রায় ১০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ পাবে ব্রোকারেজ হাউসগুলো। আর চীনা জোটের কাছে বিক্রি করা শেয়ারের অর্থ পুরোটাই পুঁজিবাজারে এলে তারল্য প্রবাহ বাড়বে বলে মনে করছেন তাঁরা।

ব্রোকাররা বলছেন, মূলধনী প্রতিষ্ঠানের মুনাফার ওপর ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়। তারল্য সংকট কাটাতে গেইন ট্যাক্সে ছাড় পেলে পুরো অর্থই আগামী তিন বছর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসেবে থাকবে। তারল্য প্রবাহ বাড়লে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বা ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনার সক্ষমতা বাড়বে।

অর্থমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউসের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বলে, আমরা করহার কমিয়ে পুরো অর্থই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের কথা বলেছি। কৌশলগত অংশীদারের কাছে শেয়ার বিক্রির অর্থ ব্রোকারেজ হাউসগুলোরই, কারণ তারাই ডিএসইর শেয়ারের আইনগত মালিক।

তারা বলছে, ২৫ শতংশ শেয়ার বিক্রির সম্পূর্ণ অর্থই আমরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করব। এতে পুঁজিবাজারে অর্থের প্রবাহ বাড়বে। ব্যাংক খাতের আর্থিক সংকটে পুঁজিবাজারেও অর্থের প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর হাতে টাকা নেই। ব্রোকারেজ হাউসগুলো পুঁজিবাজারে ৯৪৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে বাজার গতিশীল হবে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকারেজ হাউসগুলোর সংগঠন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, চীনা জোটকে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে পেতে সরকারের অনুমতি পাওয়ার পরই মূলধনী কম্পানির মুনাফায় ছাড় পেতে অর্থমন্ত্রীকে চিঠি ও পরবর্তী সময়ে বৈঠকও করেছি। অর্থমন্ত্রী বাজারে নতুন অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধিতে করছাড়ে একমত হন; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে কিছুই বলেনি। এ নিয়ে একটা টানাপড়েনের মধ্যেই ছিল ব্রোকারেজ হাউসগুলো।

জানা যায়, ডিএসইর ১৮০ কোটি ৩৭ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ শেয়ারের মালিক ২৫০ জন সদস্য। শতকরা হিসাবে প্রত্যেক সদস্যের শেয়ার ০.৪ শতাংশ বা ৭২ লাখ ১৫ হাজার ১০৬টি। সদস্যদের মোট শেয়ার থেকে কৌশলগত অংশীদারের কাছে ২৫ শতাংশ বা ৪৫ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ১২৫টি শেয়ার বিক্রি করেছে ব্রোকারেজ হাউসগুলো।

প্রতিটি শেয়ার ২১ টাকা মূল্যে এই শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ৯৪৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৬ হাজার ৬২৫ টাকা। হিসাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রির প্রায় ৯৪৭ কোটি টাকা থেকে ১৫ শতাংশ গেইন ট্যাক্স বাদ দিলে মূলধন দাঁড়ায় ৮০৪ কোটি ৯৩ লাখ ৫২ হাজার ৬৩১ টাকা। অর্থাৎ ১৪২ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হবে।

বিদ্যমান ঘোষণা অনুযায়ী, এই করহার ৫ শতাংশ করা হবে। অর্থাৎ ব্রোকারেজ হাউসগুলো ১০ শতাংশ করছাড় পাবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই করছাড় পেলে সরাসরি উপকৃত হবেন ব্রোকাররা। আর সেই অর্থ পুঁজিবাজারে এলে শেয়ারের দাম হ্রাস-বৃদ্ধির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে কিছু সুবিধা পাবে সাধারণ বিনিয়োগকারী।

৫ শতাংশ কর পরিশোধের পর ব্রোকাররা পাবেন ৮৯৯ কোটি ৬৩ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৩ টাকা। ১৫ শতাংশ কর দেওয়ার পর পাওয়ার কথা ৮০৪ কোটি ৯৩ লাখ ৫২ হাজার ৬৩১ টাকা। সে হিসাবে ব্রোকাররা এখন ৯৪ কোটি ৬৯ লাখ ৮২ হাজার ৬৬২ টাকা বেশি পাবেন। আর প্রত্যেক ব্রোকার অর্থাৎ ২৫০ জনের প্রত্যেকে পাবেন তিন কোটি ৫৯ লাখ ৮৫ হাজার ৩৪১ টাকা।

ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, গত ২৯ মে অর্থমন্ত্রীর কাছে কৌশলগত বিনিয়োগকারীর কাছে প্রাপ্য ৯৪৭ কোটি টাকার উপর ক্যাপিটাল গেইন টেক্স আরোপ না করার জন্য ডিএসই ও ডিবিএ’র নেতৃবৃন্দ আবেদন করেছিলাম। এছাড়া ওই অর্থ শহজ শর্তে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের কথা জানিয়েছিলাম।

অর্থমন্ত্রী আমাদের সেই দাবি মেনে নিয়েছেন। এজন্য অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রীর কর সুবিধা ঘোষণা ডিএসইর শেয়ারহোল্ডারদের জন্য সুখবর। একইসঙ্গে শেয়ারবাজারের জন্য ইতিবাচক খবর। কারণ এই ঘোষণার মাধ্যমে শেয়ারবাজারে নতুন বিনিয়োগের দ্বার উম্মোচন হয়েছে। এতে করে বাজারে গতি বৃদ্ধি পাবে।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মেস্তাক আহমেদ সাদেক বলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকেই করহার ছাড় দিয়ে পুঁজিবাজারে নতুন বিনিয়োগ বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছি। আমরা বলেছিলাম, গেইন ট্যাক্স কমানো হলে সব অর্থই আগামী তিন বছর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করব। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার সঙ্গে আমরাও বলতে চাই, আমরা এই অর্থ পুঁজিবাজারেই বিনিয়োগ করব। এটি বাজারের তারল্য সংকট কাটিয়ে নতুন অর্থের প্রবাহ সৃষ্টি করবে। শুধু পুঁজিবাজারের উন্নতিকল্পেই এই বিনিয়োগ করব আমরা।’

ডিএসইর এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর প্রায় এক হাজার কোটি টাকা আসা পুঁজিবাজারের জন্যই ভালো হবে, তারল্য সংকট কাটবে। করছাড় নিয়ে শর্তসাপেক্ষে বিনিয়োগের বিষয়টি নজরদারির মধ্যে রাখার পক্ষে তিনি। তিনি বলেন, ১০ শতাংশ কর কমালে ব্রোকাররা প্রায় ১০০ কোটি টাকা বেশি পাবেন। শেয়ার বিক্রির টাকা বিনিয়োগ করবেন বলে তাঁরা যেন আবার উঠিয়ে না নেন, সেটা দেখভাল করতে হবে।