DSEসাজিদ খান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের পুঁজিবাজার মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারছে না। টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মুল পুঁজি দিনের পর দিন নি:স্ব হতে চলছে। এমন অবস্থা চলছে যে পুঁজিবাজার অবিভাবকহীন। বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন আর কতদিন এ ভাবে চলবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ কি? ডিএসই নিরব ভুমিকায় কেন। এ রকম নানা প্রশ্নের বেড়াজালে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।

ফলে পতনের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না পুঁজিবাজার। কারো কথার কোন ফল দেখতে পারছে না বিনিয়োগকারীরা। ফলে পুঁজি শেষ হতে চলছেন। বর্তমানে অধিকাংশ বিনিয়োগকারীদের মুল পুঁজির ৩৫ শতাংশ হারিয়েছে। আর কিছুদিন চলতে থাকলে পুঁজি হারিয়ে নি:স্ব হয়ে যাবে বিনিয়োগকারীরা।

তাছাড়া বিএসইসির ২৫ বছর পুর্তিতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সবার প্রত্যাশা ছিল বাজার ভাল হবে। তবে টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাছাড়া চীনা কনসোর্টিয়াম ঘিরে বিনিয়োগকারীদের ফিকে হওয়া প্রত্যাশা উত্তাপ ছড়িয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর আগমন নিয়ে। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের সেই প্রত্যাশা ধরে রাখতে পারলেন না বাজার ভালো করার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও।

যদিও পুঁজিবাজারে তাকে স্বাগত জানাতে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন বাড়ানো হয়েছিল আধা ঘন্টা। এমনটা দেখে অনেকেই ধারনা করেছিলেন বাজারে গত বুধবার কিছু হতে যাচ্ছে। হয়তবা প্রধানমন্ত্রী বিনিয়োগকারীর শূন্য হাতদুটো প্রত্যাশা দিয়ে ভরিয়ে দিবেন। কিন্তু সরকার প্রধানের গতানুগতিক বক্তব্যে তাদের সে প্রত্যাশা গুড়েবালিতে পরিণত হয়েছে। ফলশ্রæতিতে পুঁজিবাজারে দর পতন ঘটেছে এবং মৌলভিত্তি সম্পন্ন অনেক শেয়ারের দরই আরো তলানিতে ঠেকেছে।

Page-01 (12)যদিও অনেকে আবার প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। কেননা তিনি বাজার উন্নয়নে ও বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় বেশ কিছু সুপারিশ করেছেন। পাশাপাশি পুঁজিবাজার হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের দীর্ঘ মেয়াদী অর্থায়নের নির্ভরযোগ্য উৎস, এখানে বিনিয়োগ করে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হোক তা সরকার চান না বলেও জানিয়েছেন।

যা বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশ বাড়াতে পারত। কিন্তু সেটা না হয়ে উল্টো চিত্র হওয়ায় দেখা দিয়েছে সংশয়। তাহলে কোন চক্র কারসাজির মাধ্যমে শেয়ার হাতানোর লক্ষ্যে পুঁজিবাজারকে কি তাদের নির্ধারিত চক্রেই রাখছে? এমন প্রশ্ন থেকেই যায়!

এদিকে কৌশলগত বিনিয়োগকারী চীনা কনসোর্টিয়ামের দেওয়া অর্থের পুরোটাই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হবে। এজন্য একটি চক্র শেয়ারের দর কমানোর পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামছে। এরা বাজাওে নানা গুজব ছড়াচ্ছে। এরা কারা এদেও চিহ্রিত করা প্রয়োজন। তাদের মূল উদ্দেশ্য পরবর্তীকালে কম দামে শেয়ার কিনে বেশি মুনাফা ঘরে নেয়া।

বড় অঙ্কের বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে শেয়ারের এমন কেনাবেচায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এজন্য তারা কোনো খাতের শেয়ারেই স্থির হচ্ছেন না। শঙ্কা কাটাতেই লেনদেন খরচের টাকা উঠলেই শেয়ার ছেড়ে আরেক খাতে বিনিয়োগ করছেন।

তবে কোন এক গোষ্ঠী অযথাই লেনদেন বাড়াচ্ছে, সরকারকে বোঝাচ্ছে লেনদেন বৃদ্ধি পাওয়া মানেই বাজার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এতে বাজারে শেয়ার লেনদেন বাড়লেও শেয়ার বিক্রির অস্বাভাবিক চাপে সূচকের পতন হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, কোনো দেশের অর্থনীতির লাইফ হচ্ছে পুঁজিবাজার। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে বাজারের ওঠানামার সঙ্গে সেই দেশের অর্থনীতি ওঠানামা করে। কিন্তু বাংলাদেশে এর উল্টো। উন্নয়নশীল দেশে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন হয় পুঁজিবাজার থেকে। অথচ বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন হচ্ছে ব্যাংক খাতের মাধ্যমে।

তাই পুঁজিবাজারের উন্নয়নে নীতিসহায়তার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থার আরো উদ্যোগী হতে হবে। তাছাড়া বাজারে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা খুবই কম। অপরদিকে ভালো শেয়ারের সংখ্যাও বেশি নয়। তাই নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠী শুধু শেয়ার অদল-বদল করেই মুনাফা তুলে নিতে তৎপর থাকে সব সময়। এখনও তাই হচ্ছে। এজন্য সার্ভিলেন্স আরও বাড়াতে হবে। বাজার ভালো রাখতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে, সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া বাজার স্থিতিশীল সম্ভব নয় বলেও মনে করছেন ওই বিশ্লেষকরা।

তাছাড়া বর্তমান বাজার দরপতনের পেছনের কারন কি এ নিয়ে দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে নানা তথ্য। আর ধারাবাহিক পতনে পাঁচকাহন বিশ্লেষণ করেছেন বাজার বিশ্লেষকরা। অন্যদিকে আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে বাজারে আরেক দফা পতন ঘটিয়ে সরকারকে বিব্রত করার অপচেষ্টা চলছে বলেও মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। তা না হলে যেখানে স্বয় প্রধানমন্ত্রী পুঁজিবাজার স্থিতিশীল দেখতে চায়, সেখানে কারা দরপতন ঘটাচ্ছে। এ বিষয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার দ্রæত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

সম্প্রতি গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, একশ্রেণীর বিনিয়োগকারীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে পুঁজিবাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলে। এর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে তারা অর্থ হাতিয়ে নেয়। এদের কারণে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে এবং অনেক বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথচ সঠিকভাবে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকৃত অর্থ দিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব।

তিনি বলেন, বিএসইসির তৎপরতায় বর্তমানে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। পুঁজিবাজার সম্পর্কে জনগণের মধ্যে যে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হয়েছিল, তাও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। এ বিষয়ে বিএসইসিকে আরো সজাগ থাকতে হবে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজার একটি তথ্যভিত্তিক জায়গা। এখানে অধিকাংশ মানুষই তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে শেয়ার কেনাবেচা করে। কারণ অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেও বাজার থেকে কোনো ভালো ফল পাওয়া যায় না। কেননা অ্যানালাইসিসে যে শেয়ারগুলো বাড়ার কথা তার উল্টো হচ্ছে। ফলে মানুষের একটি প্রবণতা আগে থেকেই আছে শুনে বিনিয়োগ করার। তাছাড়া পুঁজিবাজারে আসলে ভালো শেয়ারের অভাব রয়েছে।

দেশের অধিকাংশ বড় কোম্পানিগুলো বাজারে তালিকাভুক্ত নেই। যে কোম্পানিগুলো বাজারে আছে তার মধ্যে কিছু কোম্পানি বাদে অধিকাংশ কোম্পানির নামই মানুষ জানে না। এছাড়া অনেক দিন যাবৎ বাজারে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো ছাড়ার কথা শোনা যাচ্ছে। অথচ এ ব্যাপারে তেমন কোনো ভূমিকা বা পদক্ষেপই আমরা দেখছি না।

কাজেই রাষ্ট্রায়ত্ত, বহুজাতিক এবং দেশের ব্যক্তি মালিকানাধীন বড় কোম্পানিগুলোকে যদি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা যেত তাহলে বাজারের গভীরতা অনেক বাড়ত। কাজেই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের জরুরি পদক্ষেপ নেয়া দরকার বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সর্বশেষ ২০১০ সালের কেলেঙ্কারির পর বিগত সময়ে বাজারের গতি নানা মাত্রা পায়। বাজার সংশোধন ও দামের সীমিত উল্লম্ফণের মধ্যে মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল শিল্পে অর্থায়নের বিকল্প উৎস এই বাজার। কিন্তু হঠাৎ করেই ব্যাংকের ঋণ প্রসঙ্গ টেনে বাজার ফেলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে এবং সূচকের নিম্নগামিতা তা প্রমাণ করছে। এ অবস্থায় খুদে বিনিয়োগকারীরাও শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন।

ফলে দেশের পুঁজিবাজারে ঢুকেছে জুজুর ভয়। অজানা আশঙ্কা আর আতঙ্কে বাজারে চলছে টানা দরপতন। নীতি নির্ধারকদের কথায়ও পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। কমে গেছে তারল্য সরবরাহও। পুঁজিবাজারের এমন অবস্থার পেছনে মূলত দায়ী হচ্ছে তারল্য সংকট।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট একটি অংশ বলছে, পুঁজিবাজারে টানা দরপতনের পেছনে মুলত কোন কারন নেই। তারপর একটি চক্র সরকারকে নিবার্চনের আগে বিপদে ফেলতে নানা গুজব ছড়িয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করছে।

একাধিক বিনিয়োগকারীরা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, যেখানে প্রধানমন্ত্রী অর্থমন্ত্রী সহ পুঁজিবাজারের নীতি নির্ধারকরা বাজার ভাল করার জন্য আপ্রান চেষ্ঠা করছেন। সেখানে দরপতনের কারন কি? পুঁজিবাজারে যে দরপতন চলছে তা পরিকল্পিত। এর পেছনে ডিএসইর প্রভাবশালী ব্রোকারেজ হাউসের পাশাপাশি ছোটরাও রয়েছে। যাদের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে কিছু মার্চেন্ট ব্যাংক।

জাহিদ হোসেন নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, ব্রোকারেজ হাউসের মালিকরা একজোট হয়েছেন। অধিকাংশ হাউস শেয়ার ক্রয়-বিক্রিয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছে। নানা কৌশলে পুঁজিবাজার নিয়ে গুজব ছুড়িয়ে অস্থিতিশীল করছেন। এ অস্থিতিশীলতার পেছনে কারা দায়ী তাদেরকে চিহ্রিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। বেশ কিছু দিন ধরে তো বাজার পড়েই যাচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে শেয়ার কেনার সাহস দেখাবে।

মো. মিলন হোসেন নামের আর এক বিনিয়োগকারী বলেন, টানা দরপতনে মূলধন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। বাজার তো বেশ ভালোই ছিল। হঠাৎ এমন দরপতনের কোনো কারণ দেখি না। পুঁজিবাজারে একটি চক্র যারা বিএনপি জামায়াতের সাথে আতাত করে ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ কর্মকতাদের দিয়ে পরিকল্পতিভাবে এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে।

দরপতন ঘটাতে তারা তারল্য সংকট বিষয়টি ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের খামখেয়ালী পুঁজিবাজারের এমন অবস্থার জন্য সৃষ্টি বলে তিনি মনে করেন।