padma life desh protikhonদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বীমা খাতের কোম্পানি পদ্মা লাইফের মালিকানায় আসছে এস আলম গ্রুপ। তবে গোপনেই বিক্রি হচ্ছে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মালিকানা। কোম্পানিটির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা তাদের সব শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানটির ১৭ উদ্যোক্তা ও পরিচালকের হাতে থাকা প্রায় ৪২ শতাংশ শেয়ার কিনে নিচ্ছে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের এ শেয়ার বিক্রি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আইনও মানা হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পদ্মা ইসলামী লাইফের ১৭ উদ্যোক্তা ও পরিচালক এবং একজন শেয়ারহোল্ডারের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানটির এক কোটি ৭৪ লাখ ১০ হাজার ৯০০টি বা ৪৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ শেয়ার কিনে নিচ্ছে এস আলম গ্রুপ। এ জন্য প্রতিটি শেয়ার লেনদেনে মূল্য ধরা হয়েছে ১০ টাকা।

এসব শেয়ার কেনা হচ্ছে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম, সাইফুল আলমের স্ত্রী ফারজানা পারভীন ও ছেলে আহসানুল আলম এবং তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এফিনিটি অ্যাসেটস লিমিটেড, ক্রেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড, প্যাভিলিয়ন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ইউনিটেক্স পেট্রোলিয়াম লিমিটেড ও ইউনিটেক্স এলপি গ্যাস লিমিটেডের নামে।

চলতি বছরের ১৩ আগস্ট অনুষ্ঠিত পদ্মা ইসলামী লাইফের ১৫৪তম পর্ষদ সভায় উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়। কোম্পানিটির চেয়ারম্যান এ এফ এম ওবায়দুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় পদ্মা লাইফের সকল উদ্যোক্তা পরিচালক, পরিচালক ও উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার শেয়ার বিক্রিতে সম্মতি দেন বলে পর্ষদ সভার নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

আইন অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কাম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালক তাদের শেয়ার বিক্রি করতে চাইলে স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ঘোষণা দিতে হয়। তবে ১৩ আগস্ট পর্ষদ সভায় শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়ার পর স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে কোম্পানিটি এখন পর্যন্ত (২৩ সেপ্টেম্বর) কোনো তথ্য প্রকাশ বা ঘোষণা দেয়নি।

স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ঘোষণা ছাড়া উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার বিক্রির বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞ ও শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ঘোষণা ছাড়া তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি অবৈধ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি করতে হলে অবশ্যই স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ঘোষণা দিতে হবে। ঘোষণা ছাড়া কোনো উদ্যোক্তা ও পরিচালক শেয়ার বিক্রি করলে তা সম্পূর্ণ বেআইনি। পদ্মা ইসলামী লাইফের বিষয়টি খতিয়ে দেখে বিএসইসির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, ‘আমি বিস্মিত। কীভাবে এটা সম্ভাব। স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ঘোষণা না দিয়ে পদ্মা লাইফের উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা কীভাবে তাদের সব শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। ঘোষণা ছাড়া শেয়ার বিক্রি সম্পূর্ণ অবৈধ। এ ধরনের কোম্পানির ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম নিজের নামে (বিও নম্বর-১৬০৫১৪০০৬০০৬৩৪৯৩) ক্রয় করছেন পদ্মা ইসলামী লাইফের নয় লাখ ৮০ হাজার ৪০০টি বা দুই দশমিক ৫২ শতাংশ শেয়ার। তিনি এ শেয়ার কিনছেন পদ্মা লাইফের উদ্যোক্তা পরিচালক এ কে এম আনোয়ারুজ্জামানের কাছ থেকে।

মোহাম্মদ সাইফুল আলমের স্ত্রী ফারজানা পারভীনের নামে (বিও নম্বর-১২০৩৮৫০০৭৪৫০৪৯৪) কেনা হচ্ছে পদ্মা লাইফের ১০ লাখ ৫৬ হাজার ৯৬০টি বা ২ দশমিক ৭২ শতাংশ শেয়ার। এ শেয়ার তিনি বীমা কোম্পানিটির তিন উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডারের কাছ থেকে কিনছেন। এর মধ্যে মো. আবুল বাশারের তিন লাখ ৯০ হাজার, এ বি এম তালেব আলীর তিন লাখ ৩০ হাজার এবং রহিমা খানমের তিন লাখ ৩৬ হাজার ৯৬০টি শেয়ার রয়েছে।

সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলমের নামে (বিও নম্বর-১২০৩৩৫০০৪৪৬৫৭০৯৫) পদ্মা লাইফের ১৮ লাখ ৫০ হাজার বা ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ শেয়ার কেনা হচ্ছে বীমা কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালক এ বি এম জাফর উল্লাহর কাছ থেকে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ক্রেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডের নামে (বিও নম্বর-১৬০৫১৪০০৬৬২৫৩৭২৪) পদ্মা লাইফের ২৬ লাখ ৯৮ হাজার ১২০টি বা ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ শেয়ার কেনা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে- পদ্মা লাইফের উদ্যোক্তা পরিচালক এ টি এম এনায়েত উল্লাহর ১৩ লাখ ৯০ হাজার, নাজমুন নাহারের নয় লাখ ৬৬ হাজার ৪০০টি এবং উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার হাজী মোহাম্মদ শাহজাহানের তিন লাখ ৪১ হাজার ৭২০টি শেয়ার।

এফিনিটি অ্যাসেটস লিমিটেডের নামে (বিও নম্বর-১৬০১৫৪০০৬৬২৬০৭৭৯) কেনা হচ্ছে পদ্মা লাইফের ২৩ লাখ ৮৮ হাজার ৩২০টি বা ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ শেয়ার। এর মধ্যে রয়েছে- পদ্মা লাইফের উদ্যোক্তা পরিচালক ফাতেমা বেগমের ১২ লাখ ৪৪ হাজার ১৬০টি ও নাজিম উদ্দিন আহমেদের ১১ লাখ ৪৪ হাজার ১৬০টি শেয়ার।

প্যাভিলিয়ন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নামে (বিও নম্বর-১৬০৫১৪০০৬৬২৬০৩৬৪) কেনা হচ্ছে পদ্মা লাইফের উদ্যোক্তা পরিচালক ড. নাদিরা সাবেরিনের ১০ লাখ ৫১ হাজার ৫২০টি, এ টি এম রফিকের আট লাখ ৫২ হাজার এবং পরিচালক আবদুল মুজিব চৌধুরীর নয় লাখ সাত হাজার ২০০টি শেয়ার। প্যাভিলিয়ন ইন্টারন্যাশনালের নামে পদ্মা লাইফের ২৮ লাখ ১০ হাজার ৭২০টি বা ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ শেয়ার কেনা হচ্ছে।

ইউনিটেক্স এলপি গ্যাস লিমিটেডের নামে (বিও নম্বর-১৬০৫১৪০০৬৫৯৩৭৪৩২) কেনা হচ্ছে পদ্মা লাইফের উদ্যোক্তা পরিচালক এ এফ এম ওবায়দুর রহমানের ১৩ লাখ ২০ হাজার, জয়নাল আবেদিন জাফরের ১৪ লাখ ৫ হাজার ২০০ এবং উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার ইউসুফ ওয়াজেদ আলী চৌধুরীর তিন লাখ ৬৮ হাজার ৪০০টি শেয়ার। ফলে ইউনিটেক্স এলপি গ্যাসের নামে পদ্মা লাইফের ৩০ লাখ ৯৩ হাজার ৬০০টি বা ৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ শেয়ার কেনা হচ্ছে।

পদ্মা লাইফের উদ্যোক্তা পরিচালক আবু তাহেরের ১২ লাখ ৩৪ হাজার ৬০০টি, উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার মো. আবুল বাশারের দুই হাজার ১৮০টি এবং শেয়ারহোল্ডার ফজলে আলম ভূঁইয়ার ১২ লাখ ৯৬ হাজার শেয়ার কেনা হচ্ছে ইউনিটেক্স পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের নামে (বিও নম্বর-১৬০৫১৪০০৬৫৯৩৭০৬০)। এর মাধ্যমে ইউনিটেক্স পেট্রোলিয়ামের নামে পদ্মা লাইফের ২৫ লাখ ৩২ হাজার ৭৮০টি বা ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ শেয়ার কেনা হচ্ছে।

পদ্মা ইসলামী লাইফের মালিকদের শেয়ার বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান এ এফ এম ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘আমরা ব্যবসা ভালো করতে পারিনি। তাই গ্রাহকদের দাবিও ঠিক মতো পরিশোধ করতে পারিনি। এ জন্য কোম্পানির যে সম্পদ আছে তা বিক্রি করে গ্রাহকদের দাবি পরিশোধের চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাতেও টাকার সংস্থান হয়নি। তাই আমরা গ্রাহকদের দাবি পরিশোধের জন্য কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের সমস্যা হচ্ছে নগদ টাকার। আমরা অনেক জায়গা-জমি কিনে ফেলেছি। সেগুলো বিক্রি করে নগদ টাকা সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। তাই নগদ টাকা সংগ্রহের জন্য আমরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছি। তবে কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তন হলেও গ্রাহকদের কোনো সমস্যা নেই। মূলত গ্রাহকদের দাবি-দাওয়া পরিশোধের জন্যই সবাই কোম্পানির মালিকানা ছেড়ে দিচ্ছে।’

উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার বিক্রির বিষয়টি স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ঘোষণা না দেয়ার কারণ জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করেননি এ এফ এম ওবায়দুর রহমান।

তবে প্রতিষ্ঠানটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) চৌধুরী মোহাম্মদ ওয়াসিউদ্দীন বলেন, উদ্যোক্তা ও পরিচলকরা তাদের শেয়ার বিক্রির যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা অনুমোদনের জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে আবেদন করা হয়েছিল। আমরা আইডিআরএ’র অনুমোদন পেয়েছি। এখন মালিকরাই তাদের শেয়ার হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন।

পর্ষদ সভায় শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়ার পর স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ঘোষণা না দেয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ম্যানেজমেন্টের পার্ট। শেয়ার বিক্রি করবেন আমাদের পরিচালকরা। ওরা (পরিচালকরা) যাদের কাছে শেয়ার বিক্রি করবেন তাদের সঙ্গে ইন্টারনাল কথাবার্তা হয়েছে এবং কনসালটেন্ট কাজ করছে। এমডি হিসেবে আমার দায়িত্ব আইডিআরএকে জানানো, আমি জানিয়েছি।’

যোগাযোগ করা হলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, ‘তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালক তাদের শেয়ার বিক্রি করতে চাইলে অবশ্যই স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ঘোষণা দিত হবে। পদ্মা ইসলামী লাইফ কোনো ঘোষণা দিয়েছে কিনা বা ঘোষণা দিলে কোন ধরনের ঘোষণা দিয়েছে- এ বিষয়ে আমার কাছ কোনো তথ্য নেই। তবে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হলে আমরা অবশ্যই পদক্ষেপ নেবো।’

বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সদস্য গকুল চাঁদ দাস বলেন, ‘পদ্মা ইসলামী লাইফের উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা শেয়ার বিক্রি সংক্রান্ত তথ্য আমাদের জানিয়েছেন। তালিকাভুক্ত কোম্পানি হওয়ায় বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জকেও এ তথ্য জানানোর কথা। কিন্তু বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জকে বিষয়টি জানানো হয়েছে কিনা- সেটা আমি বলতে পারবো না।’

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্না ইমন বলেন, ‘পদ্মা ইসলামী লাইফের উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বা বিক্রি করে দেবেন- এমন কোনো তথ্য আমার জানা নেই। কোম্পানির উদ্যোক্তারা শেয়ার বিক্রি করলে অবশ্যই স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ঘোষণা দিতে হবে।’ ‘পদ্মা ইসলামী লাইফের বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখবো। যদি উদ্যোক্তারা শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম করেন, অবশ্যই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে’- যোগ করেন তিনি।