padma-meghna-jumanaদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। ব্যাংক, আর্থিক ও প্রকৌশল খাতের পর বর্তমানে পুঁজিবাজারে শক্তিশালী খাত হিসাবে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাত। এর মধ্যে জ্বালানী খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো এবার ডিভিডেন্ডের ভালো চমক দেখিয়েছে।

জ্বালানী খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত তিন কোম্পানিতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্য বর্তমান উপযুক্ত সময় বলে মনে করছেন বাজর বিশ্লেষকরা। কারন কোম্পানিগুলো প্রতিবছর ভালো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে। এসব কোম্পানি দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করলে কেউ লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ব্যবসায় ইতিবাচক অবস্থা অব্যাহত থাকার পাশাপাশি দেশের বাজারে তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো আগের তুলনায় আরও বেশি ভাল করার সুযোগ পাচ্ছে, যার কারনে এদের অবস্থা দিন দিন ভাল হচ্ছে।

তবে জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাতের সিংহভাগ কোম্পানি বড় মূলধনী হলেও ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের তুলনায় এ খাতের মাত্র কয়েকটি কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে। ফলে এ খাতের প্রতি সাধারন বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশী আকর্ষণও বাড়ছে।

তাছাড়া এ খাতের কোম্পানিগুলো শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১০০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। যার কারণে বিনিয়োগকারীরা এ খাতে আকৃষ্ট হয়ে থাকে বলে মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিবারের ধারাবাহিকতায় ৩০ জুন, ২০১৮ সমাপ্ত বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিতে কোম্পানিগুলো যথেষ্ট ভালো পারফর্ম করেছে।

এদিকে জ্বালানি তেল বিপণনকারী রাষ্ট্রায়ত্ত পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা মূল ব্যবসা থেকে যে টাকা আয় করে, তার কয়েকগুণ বেশি করে ব্যাংকে রাখা আমানতের সুদ থেকে। এ কারণেই সরকারি তেল কোম্পানিগুলো প্রতিবছর আকাশচুম্বী মুনাফা দেখাতে পারছে। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েলের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য মিলেছে।

চলতি হিসাব বছরের ৯ মাসের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সময় যমুনা অয়েল লিমিটেডের পরিচালন মুনাফা হয় ২২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। আর একই সময়ে ব্যাংকে রাখা স্থায়ী ও স্বল্পমেয়াদি আমানত থেকে সুদ বাবদ আয় হয়েছে ২৪১ কোটি। একইভাবে পদ্মা অয়েল কোম্পানির পরিচালন মুনাফা ৬৭ কোটি ২৩ লাখ। আর সুদ বাবদ আয় হয়েছে ১৯৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। জ্বালানি পরিবহন ও বিপণন থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত অপর কোম্পানি মেঘনা পেট্রোলিয়াম চলতি হিসাব বছরের ৯ মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৫৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। আর একই সময়ে কোম্পানিটির সুদ বাবদ আয় ২২০ কোটি।

শুধু চলতি বছরই নয়, এর আগেও কোম্পানি তিনটি যে নিট মুনাফা করেছে, তার বড় অংশই এসেছে সুদ থেকে। বিভিন্ন ব্যাংকে এ তিন কোম্পানির ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি আমানত রয়েছে, যা এদের উচ্চ মুনাফায় প্রধান ভূমিকা রাখছে। এসব কোম্পানি জ্বালানি তেল বাজারজাতকরণের পাশাপাশি লুব্রিকেন্ট অয়েলের ব্যবসাও করছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে তারা কাজ শুরু করেছে।

২০১৬-১৭ হিসাব বছরে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের পরিচালন মুনাফা হয় ৭৩ কোটি টাকা। আর এ সময় ব্যাংকে গচ্ছিত আমানত থেকে সুদ বাবদ আয় করে ২৩৯ কোটি। নিট মুনাফা হয় ২১৯ কোটি টাকা। আগের বছর পরিচালন মুনাফা ছিল ৪৩ কোটি ও সুদ বাবদ আয় ছিল ২২০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ হিসাব বছর পর্যন্ত মেঘনা পেট্রোলিয়ামের সুদ বাবদ আয় হয় ১ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। আর এ সময়ে পরিচালন মুনাফা হয় ৩৩১ কোটি। ২০১৬-১৭ হিসাব বছর শেষে বিভিন্ন ব্যাংকে মেঘনা পেট্রোলিয়াম অয়েলের স্থায়ী ও স্বল্পমেয়াদি আমানতের পরিমাণ হচ্ছে ৩ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে যমুনা অয়েলের পরিচালন আয় ধারাবাহিকভাবে কমেছে। বিপরীতে সুদ বাবদ আয় বাড়ছে। যমুনা অয়েল ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে পরিচালন মুনাফা করে ৩১ কোটি টাকা। আর এ সময় বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা আমানত থেকে সুদ পায় ২৮১ কোটি। সর্বশেষ হিসাব বছরে কর পরিশোধের পর নিট মুনাফা হয় ২২৪ কোটি। ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে যমুনা অয়েলের পরিচালন মুনাফা ৩৩ কোটি ও সুদ আয় ২৪০ কোটি টাকা।

২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ হিসাব বছর পর্যন্ত যমুনার সুদ বাবদ আয় হয় ১ হাজার ১১১ কোটি টাকা। একই সময়ে কোম্পানির পরিচালন মুনাফা ছিল ৩৯০ কোটি। ২০১৬-১৭ হিসাব বছর শেষে বিভিন্ন ব্যাংকে যমুনা অয়েলের স্থায়ী ও স্বল্পমেয়াদি আমানতের পরিমাণ হচ্ছে ১ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে ১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা রয়েছে স্বল্পমেয়াদি আমানত হিসেবে।

রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলোর মধ্যে যমুনার ব্যবসায় কিছুটা বৈচিত্র্য রয়েছে। তেল বাজারজাতকরণের পাশাপাশি অন্য কোম্পানির সঙ্গে এটি এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেড ও ওমেরা ফুয়েলস লিমিটেড গড়ে তুলেছে। ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে পদ্মা অয়েলের পরিচালন মুনাফা হয় ১০৬ কোটি টাকা। এ সময় সুদ বাবদ আয় হয় ১৭৮ কোটি।

আগের বছর পরিচালন আয় ছিল ১১৩ কোটি ও সুদ বাবদ আয় ১৪৯ কোটি। গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা আমানত থেকে পদ্মা অয়েল ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা সুদ পেয়েছে। ২০১৬-১৭ হিসাব বছর শেষে বিভিন্ন ব্যাংকে পদ্মা অয়েলের নগদ ও স্থায়ী আমানত দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে পদ্মা অয়েলের কোম্পানি সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা ঠিক যে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলোর মুনাফার বড় অংশই আসছে সুদ থেকে। আর মূল ব্যবসা থেকে আয় না বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পণ্য বাজারজাতকরণে কমিশন কিংবা মার্জিন বাড়লেও বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন কারণে প্রশাসনিক ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে পরিচালন মুনাফা একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনা প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, কয়েক বছর আগে পদ্মা অয়েল এগ্রো-কেমিক্যালের ব্যবসায় নেমেছে। তবে এ খাতে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে সফলতা তেমন আসছে না। এরপরও আমরা ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আমাদের জমি আছে, যেগুলোয় বাণিজ্যিক ভবন তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এসব ভবন ভাড়া দিয়ে ভিন্ন আয়ের উৎস বের করা হবে।

মেঘনা পেট্রোলিয়াম: পুঁজিবাজারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড ৩০ জুন, ২০১৮ সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য ১৪০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি কোম্পানিটি চলতি অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর’১৮) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানির ইপিএস আগের তুলনায় ৩৩.৬৬ শতাংশ বেড়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, ৩০ জুন, ২০১৮ সমাপ্ত অর্থবছরে কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৩৩.৩০ টাকা। যা এর আগের বছর একই সময় ছিল ২০.২৮ টাকা। সে হিসেবে কোম্পানির ইপিএস বেড়েছে ১৩.০২ টাকা বা ৬৪.২০ শতাংশ।

এছাড়া আলোচিত সময় কোম্পানির শেয়ার প্রতি নেট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো (এনওসিএফপিএস) হয়েছে ১১১.৭৭ টাকা এবং শেয়ার প্রতি প্রকৃত সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) হয়েছে ১১৩.২০ টাকা। ঘোষিত ডিভিডেন্ড বিনিয়োগকারীদের সম্মতিক্রমে অনুমোদনের জন্য এ কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) ২০১৯ সালে ১২ জানুয়ারী, সকাল সাড়ে ১১টায় সিটি হল কনভেনশন সেন্টার, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম অনুষ্ঠিত হবে। এ সংক্রান্ত রেকর্ড ডেট নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ২ ডিসেম্বর।

এদিকে, প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই’১৮-সেপ্টেম্বর’১৮) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৮.০৬ টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৬.০৩ টাকা। সে হিসেবে কোম্পানির ইপিএস বেড়েছে ২.০৩ টাকা বা ৩৩.৬৬ শতাংশ।

এছাড়া আলোচিত সময় কোম্পানির শেয়ার প্রতি নেট অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো (এনওসিএফপিএস) হয়েছে ৪৯.৮৫ টাকা। ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ পর্যন্ত কোম্পানির শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) হয়েছে ১২১.২৬ টাকা।

পদ্মা অয়েল: শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত পদ্মা অয়েল সমাপ্ত অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১৩০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। কোম্পানি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

২০১৭-২০১৮ হিসাব বছরে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৩৪.১৮ টাকা। এর আগের বছর একই সময়ে ইপিএস ছিল ২০.৬৮ টাকা। এছাড়া শেয়ার প্রতি প্রকৃত সম্পদ মূল্য (এনএভি) হয়েছে ১২৬.৭৮ টাকা এবং শেয়ার প্রতি নগদ কার্যকর অর্থ প্রবাহ (এনওসিএফপিএস) হয়েছে ৩৬.৩৭ টাকা (ঋণাত্মক)।

ঘোষিত লভ্যাংশ ও অন্যান্য আলোচ্য বিষয়সমূহ শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদনের জন্য কোম্পানিটির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) আগামী১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ অনুষ্ঠিত হবে। এলক্ষ্যে শেয়ারহোল্ডার নির্বাচনের জন্য আগামী ১৯ ডিসেম্বর রেকর্ড ডেট নির্ধারণ করা হয়েছে।

ইষ্টার্ণ লুব্রিক্যান্টস: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইষ্টার্ণ লুব্রিক্যান্টস লিমিটেড ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ১০০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। কোম্পানি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। আজ অনুষ্ঠিত কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, সমাপ্ত অর্থবছরে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৩৬.২৩ টাকা। কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) আগামী ১৯ জানুয়ারি,২০১৯ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে। ডিভিডেন্ড সংক্রান্ত রেকর্ড ডেট ৩ ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে।