DSEদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের মোট বাজার মূলধনের ৪৩ দশমিক ৭ শতাংশই শীর্ষ দশ কোম্পানির দখলে। ফলে পুঁজিবাজারের উত্থান-পতনে এ কোম্পানিগুলোর বড় ধরনের প্রভাব থাকে। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর পুঁজিবাজারের সূচক ও লেনদেন ছিল নিম্নমুখী। এর প্রভাবে এক বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন সাড়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা কমেছে। এর মধ্যে বাজার মূলধনে শীর্ষ ছয় কোম্পানির মূলধন কমেছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।

ডিএসই ও ইবিএল সিকিউরিটিজের তথ্যানুসারে, ২০১৮ সালে দেশের পুঁজিবাজারে বাজার মূলধনে শীর্ষ ১০ কোম্পানি হচ্ছে গ্রামীণফোন, ব্রিটিশ আমেরিকা টোব্যাকো বাংলাদেশ লিমিটেড (বিএটিবিসি), স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড, রেনাটা লিমিটেড, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ লিমিটেড (আইসিবি), ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড,

লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেড ও অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এর মধ্যে গত এক বছরে লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, আইসিবি, গ্রামীণফোন, ব্র্যাক ব্যাংক ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের বাজার মূলধন কমেছে ২৪ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। বিপরীতে ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ, রেনাটা ও বিএটিবিসির বাজার মূলধন বেড়েছে ৯ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকার।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী বলেন, মূলত দুটি কারণে ডিএসইর পাশাপাশি শীর্ষ মূলধনি কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধন কমেছে। একটি হচ্ছে, গত বছর বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়ায় থাকা বেশকিছু বড় কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ারে ২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। শীর্ষ মূলধনি কোম্পানিগুলোর শেয়ার বিক্রি করে সেই টাকা প্লেসমেন্ট শেয়ারে বিনিয়োগ করা হয়েছে।

আরেকটি কারণ হচ্ছে, দুই অংকের সুদের হারের কারণে অনেকেই পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে ব্যাংকে টাকা রেখেছে, যা বাজার মূলধন কমার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। তাছাড়া ২০১৭ সালে গ্রামীণফোনের শেয়ারদর ছিল ঊর্ধ্বমুখী, যা এ বছরের শুরুতে এসে ৫০০ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তবে এর পর থেকেই শেয়ারটির দর কমতে থাকে এবং বছর শেষে এসে ৩৬৭ টাকায় দাঁড়ায়। বাজার মূলধন কমার পেছনে গ্রামীণফোনের এ দরপতন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে বলেও জানান তিনি।

এক বছরে সবচেয়ে বেশি ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ বা ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা মূলধন হারিয়েছে বহুজাতিক সিমেন্ট কোম্পানি লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ। যেখানে ২০১৭ সালে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ৮ হাজার ১১৮ কোটি টাকা, সেটি ২০১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫২ কোটি টাকায়। ডিএসইর মোট বাজার মূলধনের দেড় শতাংশ বহুজাতিক কোম্পানিটির দখলে রয়েছে।

দেশের বিস্কুট ইন্ডাস্ট্রির শীর্ষ প্রতিষ্ঠান অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ এক বছরে ২৫ শতাংশ বা ১ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার মূলধন হারিয়েছে। ২০১৭ সালে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ৫ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা, যা ২০১৮ সালে এসে ৪ হাজার ৩২২ কোটি টাকা হয়েছে। কোম্পানিটির দখলে ছিল ডিএসইর মোট বাজার মূলধনের ১ দশমিক ৩ শতাংশ।

রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবির এক বছরে মূলধন কমেছে ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ বা ২ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ১০৭ কোটি টাকায়, যা আগের বছরে ছিল ১০ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। ডিএসইর মোট বাজার মূলধনের আড়াই শতাংশ ছিল আইসিবির দখলে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় টেলিকম অপারেটর গ্রামীণফোনের বাজার মূলধন ২০১৮ সালে ২২ শতাংশ বা ১৩ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা কমে ৪৯ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা আগের বছরে ছিল ৬৩ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা। ডিএসইর মোট বাজার মূলধনের ১৫ দশমিক ২ শতাংশই হচ্ছে গ্রামীণফোনের।

২০১৮ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের বাজার মূলধন কমেছে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ বা ১ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ব্যাংকটির বাজার মূলধন ছিল ৯ হাজার ২৭০ কোটি টাকা, যা এ বছর এসে ৭ হাজার ৭৭১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ডিএসইর মোট বাজার মূলধনের ২ দশমিক ৪ শতাংশ ব্র্যাক ব্যাংকের।

দেশের ওষুধ খাতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের বাজার মূলধন এক বছরে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ বা ২ হাজার ৪৪ কোটি টাকা কমেছে। ২০১৭ সালে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ২০ হাজার ৭০১ কোটি টাকা, যা ২০১৮ সালে এসে ১৮ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ডিএসইর মোট বাজার মূলধনের ৫ দশমিক ৭ শতাংশ স্কয়ার ফার্মার।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) পরিচালক মো. ছায়েদুর রহমান বলেন, বাজার মূলধন কমে যাওয়া মানে এটা নয় যে, পুঁজিবাজার থেকে টাকা কেউ নিয়ে গেছে। মূলত সার্বিকভাবে বাজারে অংশগ্রহণ কমার কারণেই মূলধন কমেছে। সূচক ও লেনদেনে নিম্নমুখী প্রবণতা থাকলে সার্বিকভাবে সব কোম্পানির শেয়ারেই এর প্রভাব পড়ে। নির্বাচনের কারণে এ বছর বিনিয়োগকারীরা রক্ষণাত্মক অবস্থানে ছিলেন, যার প্রভাব পড়েছে বাজারে। তবে সামনের বছরে পুঁজিবাজার নিয়ে আমি বেশ আশাবাদী।

ডিএসইর কৌশলগত অংশীদার বেছে নেয়া ছিল এ বছরে পুঁজিবাজারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি (সিসিপি), স্মল ক্যাপ বোর্ড, অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ডের (এটিবি) মতো বেশকিছু বিষয় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। এগুলো দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। আমি মনে করি, আগামী বছর পুঁজিবাজারের লেনদেন ২০১৮ সালের তুলনায় দ্বিগুণে উন্নীত হবে।

অন্যদিকে পুঁজিবাজারে বাজার মূলধনে শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে চারটির মূলধন গত এক বছরে ৯ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯২ দশমিক ৬ শতাংশ বা ৬ হাজার ৮৮ কোটি টাকা মূলধন বেড়েছে ইউনাইটেড পাওয়ারের। ২০১৭ সালে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ৬ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা। ডিএসইর মোট বাজার মূলধনের ৩ দশমিক ৯ শতাংশ ছিল ইউনাইটেড পাওয়ারের দখলে।

বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের বাজার মূলধন বেড়েছে ৩০ দশমিক ৩ শতাংশ বা ১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ৪ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। ডিএসইর মোট বাজার মূলধনের ১ দশমিক ৯ শতাংশ বার্জার পেইন্টসের দখলে।

রেনাটার বাজার মূলধন বেড়েছে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ বা ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ৭ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। ডিএসইর মোট বাজার মূলধনের ২ দশমিক ৮ শতাংশ রেনাটার দখলে।

তামাক খাতের বহুজাতিক জায়ান্ট বিএটিবিসির বাজার মূলধন এক বছরে ৪ দশমিক ১ শতাংশ বা ৮৪০ কোটি টাকা বেড়েছে। ২০১৭ সালে কোম্পানিটির বাজার মূলধন ছিল ২০ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। ডিএসইর মোট বাজার মূলধনের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বিএটিবিসির দখলে।