দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ঋণমান সনদে আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। নীতি-নির্ধারনী সংস্থাগুলোর উদাসীনতায় রেটিং এজেন্সিগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছে তীব্র অসুস্থ প্রতিযোগীতা। আর এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার সুযোগ নিয়েই মুলত অযোগ্য কোম্পানিগুলোও ভালো রেটিং ধারন করে পুঁজিবাজারে ঢোকার সুযোগ পাচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অনৈতিক রেটিং প্রদানের ফলশ্রুতিতেই বিনিয়োগকারীরা তালিকাভূক্ত কোম্পানির ব্যাপারে ভুল মেসেজ পাচ্ছে। ফলে নিশ্চিত বাড়ার সম্ভবনাযুক্ত কোম্পানিগুলোর দাম যখন পড়ে যায় তখন তারা প্রতারনার স্বীকার হচ্ছে।

ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার মান নিয়ে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলোর সনদে কোম্পানির আর্থিক স্বাস্থ্যের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা হয় না বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রয়োজনের চেয়ে এসব এজেন্সির সংখ্যা বেশি হওয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমঝোতার মাধ্যমে দেওয়া ঋণমান সনদে কোম্পানির সক্ষমতা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা।

এ ধরনের সনদ দেখিয়ে ঋণ নিয়ে কোম্পানিগুলো সময়মতো শোধ না করায় একদিকে যেমন খেলাপি ঋণ বাড়ছে, অন্যদিকে এ ধরনের সনদের ভিত্তিতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে কোম্পানিগুলো লোকসানি হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শেয়ারহোল্ডাররা।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকায়, যা জাতীয় বাজেটের ২১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশই এখন খেলাপি। অবলোপন করা ঋণ যোগ হলে প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশে। খেলাপি ঋণের বড় অংশই কোম্পানিগুলোর নেওয়া শিল্পঋণ। সর্বশেষ হিসাবে মোট শিল্পঋণের প্রায় ৪০ শতাংশই খেলাপি।

এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির চেয়ারম্যান ও বেসরকারি ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, বাংলাদেশের সব রেটিং এজেন্সি মানসম্মত প্রতিবেদন দিতে পারছে না। এ কারণেই শুধু ঋণমান সনদের ওপর ভিত্তি করে ঋণ দেওয়া হয় না। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের তারল্য প্রবাহ, সম্পদ, মুনাফা ও ব্যবস্থাপনা বিশ্লেষণ করা হয়।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির তালিকাভুক্ত ঋণমান সনদদাতা ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি রয়েছে আটটি। অথচ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপানে ঋণমান সনদদাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সাতটি। ১০ গুণ বড় অর্থনীতির দেশ ভারতেও একই সংখ্যক রেটিং এজেন্সি রয়েছে। পাকিস্তানে দুটি ও শ্রীলঙ্কায় চারটি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বাধ্যতামূলক না হলেও ব্যাংকগুলো সাধারণভাবে সতর্কতার জন্য ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রাহকদের কাছ থেকে ক্রেডিট রেটিং রিপোর্ট (ঋণমান সনদ) নিয়ে থাকে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হলে কোম্পানির ঋণমান সনদ জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এ ক্ষেত্রে ঋণমান হতে হবে অন্তত ‘এ’, যার অর্থ ঋণ পরিশোধে কোম্পানিটির অবস্থান শক্তিশালী।

ঋণমান সনদ নিয়ে আস্থাহীনতার কথা স্বীকার করে সনদদাতা এসব এজেন্সিগুলোর সমিতি দি অ্যাসোসিয়েশন অব ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ইন বাংলাদেশের (এসিআরএবি) প্রেসিডেন্ট মোজাফফর আহমেদ দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, ‘মানসম্মত ঋণমান সনদ দেওয়া হলে অনেক কোম্পানি ব্যাংক থেকে ঋণই পেত না। ফলে খেলাপির পরিমাণও এতটা বাড়ত না।

বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার অনুযায়ী, একটি কিংবা দুটি রেটিং এজেন্সি থাকতে পারে। কিন্তু এখানে রয়েছে আটটি। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এজেন্সিগুলো যার যে ধরনের রেটিং প্রয়োজন হচ্ছে, যাচাই-বাছাই ছাড়াই তা দিয়ে দিচ্ছে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঋণমান সনদে কোম্পানির প্রকৃত চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না।’

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, তালিকাভুক্তির সময় কোম্পানির ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা শক্তিশালী দেখানো হলেও পরে দুর্বল হতে দেখা গেছে। খোদ মোজাফফরের প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট রেটিং ইনফরমেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (সিআরআইএসএল) দেওয়া ঋণমান সনদের যথার্থতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। এই এজেন্সি ২০১৩ সালে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডকে ‘এ মাইনাস’ ঋণমান সনদ দেয়। ২০১৪ সালে কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে পরের বছর থেকেই সংকটে পড়ে যায়।

২০১৬ সালে কোম্পানিটি খেলাপি হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে রানকা ডেনিম টেক্সটাইল মিলসকে মাঝারি (ট্রিপল বি টু) ঋণ পরিশোধ সক্ষমতায় মাঝারি অবস্থানের সনদ (ক্রেডিট রেটিং রিপোর্ট) দেয় ওয়াসো ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি। পরের বছরই কোম্পানিটি খেলাপি হয়ে পড়ে।

এ বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, এতগুলো রেটিং এজেন্সির কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি যখন বিএসইসিতে দায়িত্বে ছিলাম তখন একটিমাত্র এজেন্সিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। তবে ‘মনোপলি’ ঠেকাতে পরে আরেকটি কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। এখন দেশে রেটিং এজেন্সির সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। কোম্পানির সঙ্গে আপস করে ঋণমান সনদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কোনো কোম্পানি যদি ইচ্ছে করে ধারাবাহিকভাবে খারাপ রেটিং দিয়ে থাকে, তাহলে বিএসইসির উচিত সে কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করা।

ঋণমান সনদ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় ২০১২ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিসহ ছয় সংস্থার বৈঠকে ক্রেডিট রেটিং কোম্পানির পরিদর্শন ম্যানুয়াল সংশোধন করে ২০১৩ সালের মার্চে খসড়া কমিশনে দাখিল হয়। সাড়ে পাঁচ বছর পার হলেও যাচাই-বাছাই সম্পন্ন না হওয়ায় ম্যানুয়াল তৈরির কার্যক্রম ঝুলে রয়েছে। এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো অগ্রগতি জানাতে পারেননি।