দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ২০১০ সালের পর দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশিদের মধ্যে বিনিয়োগের প্রবণতা বেড়ে যায়। কম দামে শেয়ার কিনতে বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা অন্তত সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। চলতি বছর নিট বিনিয়োগের কিছু অংশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হলেও সব মিলে বিদেশি বিনিয়োগ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় ২০০৪ সাল থেকে। এর আগে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা হতে পারে বলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কর্মকর্তাদের ধারণা।

ডিএসই থেকে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পুঁজিবাজারে বিদেশিদের নিট বিনিয়োগ ছিল ৮ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। আর চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত ৪৯৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তারা। সব মিলে বর্তমানে পুঁজিবাজারে প্রায় শতকোটি (৯৪ কোটি ৩৭ লাখ) ডলারের নিট বিনিয়োগ রয়েছে বিদেশিদের।

পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরা জানান, অর্থনীতির নানা সূচকে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় অগ্রগতির খবর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অজানা নয়। বিশ্বের খ্যাতনামা বিনিয়োগ ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী।

তবে ভালো শেয়ারের অভাবে ইচ্ছা থাকলেও তারা বেশি বিনিয়োগ করতে পারছেন না। ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী দেশ প্রতিক্ষণকেবলেন, ব্যাংক ও বহুজাতিক কোম্পানিসহ সুখ্যাতি রয়েছে, এমন স্থানীয় কোম্পানিতে বিদেশিরা সাধারণত শেয়ারে বিনিয়োগ করে থাকেন। এগুলোর অধিকাংশের শেয়ার এখন যৌক্তিক মূল্যে অবস্থান করছে। এই সময়টা তাদের জন্য বিনিয়োগের অনুকূল। যেসব বিদেশি দেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন, তাদের সিংহভাগই ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিনিয়োগ কোম্পানি।

এ ছাড়া সিঙ্গাপুর, দুবাইভিত্তিক কিছু বিনিয়োগ কোম্পানিরও বিনিয়োগ রয়েছে। নরডিক দেশগুলোর ব্যবসায়ীদের সমন্বিত বিনিয়োগ কোম্পানি ব্রামার্স অ্যান্ড পার্টনারস দেশের শেয়ারবাজারের প্রায় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১০ সালের বাজার ধসের পরের বছর থেকে বিদেশি বিনিয়োগের উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে। ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নিট বিনিয়োগে ইতিবাচক ধারা ছিল। এ সময় টানা সাত বছরে বিদেশিরা ৮ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা নিট বিনিয়োগ করেছেন। চলতি বছরে এসে নভেম্বর পর্যন্ত তারা ৪৯৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেন, যার সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক দেখছেন খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে সম্মিলিতভাবে বিদেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশের শেয়ারবাজারে নিট ১৭৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তবে এ সময়ে শেয়ারবাজারের লেনদেনে তাদের অংশ কমেছে। গত ডিসেম্বরে মোট লেনদেনে ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ ছিল বিদেশিদের, তা জানুয়ারিতে এসে নেমেছে ১ দশমিক ৮২ শতাংশে।

তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের ডামাডোলের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ব্যাংক ও বন্ডের সুদহার বৃদ্ধি এবং টাকার মান পড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের একটা অংশ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছিলেন। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ছিল নিট ৩২৫ কোটি টাকা।

বিদেশিদের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের কারণে গ্রামীণফোন, স্কয়ার ফার্মাসহ বহুজাতিক কোম্পানির বেশিরভাগ শেয়ার দর হারিয়েছিল। কিন্তু জানুয়ারি মাস থেকে এসব শেয়ারের দর ফের বাড়তে দেখা যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, বিদেশিদের বিক্রির তুলনায় বেশি শেয়ার কেনার প্রভাবেই এমনটি হচ্ছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইর মাধ্যমে জানুয়ারিতে মোট ৪৯৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা মূল্যের শেয়ার কিনেছেন বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা। বিপরীতে ৩১৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা মূল্যের শেয়ার বিক্রি করেছেন। অর্থাৎ গত মাসে তারা নিট ১৭৫ কোটি ২৭ লাখ টাকার শেয়ার কিনেছেন। তবে তারা কোন শেয়ার বিক্রি করেছেন এবং কোনটি কিনেছেন, সে তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।

ডিএসইতে জানুয়ারি মাসে কেনাবেচা হওয়া শেয়ারের মোট বাজার মূল্য ছিল ২২ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। কেনা ও বেচা উভয় দিক বিবেচনায় নিলে এর পরিমাণ দ্বিগুণ। এ লেনদেনে বিদেশিদের কেনার পরিমাণ ছিল মোটের ২ দশমিক ২২ শতাংশ। মোট বিক্রিতে তাদের অংশ ছিল মোটের ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

তবে জানুয়ারি মাসে বিদেশিরা যতটুকু শেয়ার কেনাবেচা করেছেন, তার প্রায় পুরোটাই হয়েছে ডিএসইর মাধ্যমে। দেশের দ্বিতীয় শেয়ারবাজার সিএসইর মাধ্যমে তারা মাত্র দুই লাখ ৭৪ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন করেন। ২৭৪ টাকা দরে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের মাত্র এক হাজার শেয়ার কেনাবেচা করেন এক বিদেশি বিনিয়োগকারী।

গত বছরের পুরোটা সময় বিদেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীরা শুধু ডিএসইর মাধ্যমে ৯ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা করেছিলেন। এর মধ্যে চার হার ৪৯৬ কোটি টাকার শেয়ার কেনেন এবং বিক্রি করেন প্রায় পাঁচ হাজার ৯০ কোটি টাকার শেয়ার। ডিএসইতে গত বছর সর্বমোট এক লাখ ৩৩ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়। এ লেনদেনে বিদেশিদের অংশ ছিল মোটের ৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

ব্র্যাক ইপিএল ব্রোকারেজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শরীফ এম এ রহমান দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, নির্বাচনের আগে বিদেশিদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা লক্ষ করা গেলেও নির্বাচনের পর ক্রয়ের প্রবনতা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এটা বাজারের জন্য ভাল দিক।