দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বর্তমান সরকারের বিগত ১০ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৭৬ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৯ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। ১০ বছর আগে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। একই সময়ে খেলাপি থেকে অবলোপন করা হয়েছে (রাইট আপ) করা হয়েছে প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা। সবমিলে ব্যাংকিং খাতে মন্দ মানের ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ।

এ প্রেক্ষাপটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল স¤প্রতি বলেছেন, ‘খেলাপি ঋণ ম্যানেজেবল, খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না।’ অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যকে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা হিসেবে বিবেচনা করে বাস্তবায়ন দেখতে চান দেশের অর্থনীতিবিদরা।
তারা মনে করছেন, খেলাপি ঋণ শুধু বর্তমান অবস্থাতে ধরে রাখা নয়, ব্যাংকিং খাতের ভঙ্গুর অবস্থার উন্নতি করতে এর পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে অবস্থান ঘোষণা করে অর্থমন্ত্রী যে আশা জাগিয়েছেন, সেটার বাস্তবায়ন দেখতে চায় দেশের মানুষ।

আমাদের প্রতিবেদকের কাছে এ প্রতিক্রিয়া জানান সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, খেলাপি, অবলোপন (রাইট আপ) ও পুনঃতফসিলি মিলে মন্দঋণ ব্যাংকিং খাতকে নাজুক অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি বাস্তব কাজে প্রতিফলন দেখাতে হবে।

খেলাপিরা যাতে রিট করে ব্যাংকের টাকা আটকে দিতে না পারেন সে জন্য বিচার বিভাগকে ভূমিকা রাখতে হবে। বিপুল পরিমাণ অর্থ খেলাপি গ্রাহকদের কাছে আটকে থাকলেও আমানতের সুদের ভার বহন করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। এ ভার কমাতে ভালো গ্রাহকের ওপরে সুদের হার বাড়ানো হচ্ছে। এ জন্য খেলাপি ঋণ শুধু কমিয়ে আনাই নয়, যৌক্তিক হারে কমিয়ে আনতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান সরকার বিগত ১০ বছরে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করেছে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের কেলেঙ্কারি এসব অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। এ জন্য চলতি মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান সরকার ব্যাংকিং খাতকে দুরবস্থা থেকে উত্তরণের পদক্ষেপের কথা জোরেশোরে বলছে। খেলাপি ঋণ যেন আর না বাড়ে এই লক্ষ্যে নেমেছে শক্তভাবে। এ জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ কমিটির কার্যকলাপ হবে অনেকটা টাস্কফোর্সের মতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের নেতৃত্বে গঠিতব্য এ কমিটির প্রধান কাজ হবে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে সুপারিশ দেওয়া। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের আদায় কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়েও কাজ করবে কমিটি। শিগগিরই কমিটি গঠন হবে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তুত করা আর্থিক স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ ঝুঁকির বিষয়ে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ তিনজন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে নতুন করে ২১টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়বে। যদি শীর্ষ ১০ ঋণগ্রহীতা খেলাপি হয় তাহলে ৩১টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দেখা দেবে।

খেলাপি ঋণের বিষয়ে বলা হয়েছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতে রয়েছে, সেটা যদি আরও ১৫ শতাংশ বাড়ে, তাহলে মূলধন ঘাটতিতে পড়বে ৩৫টি ব্যাংক। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ৯৯ হাজার ৩৭১ কোটি টাকার ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়েছে যা ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। মূলধন ঘাটতিতে ছিল ৯টি ব্যাংক।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল শপথ নেওয়ার পরই ঘোষণা দিয়েছেন, খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমলে ব্যাংক ঋণের সুদের হারও কমে যাবে। সুতরাং এটা কোনোভাবেই বাড়তে দেওয়া হবে না। তিনি আরও বলেন, নন-পারফরমিং লোন (খোলাপি ঋণ) এখনো ম্যানেজেবল। আর এই ম্যানেজেবল লোন আর বাড়তে পারবে না।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টে (বিআইবিএম) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই খেলাপি ঋণ কমে আসবে। এর পেছনে তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, বিগত বছরের খেলাপি ঋণের ধারা বিশ্লেষণে দেখা যাবে, প্রতিবছরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসিকে খেলাপি ঋণ বাড়ে। তবে ডিসেম্বর প্রান্তিকে এটা কমে আসে। খেলাপি ঋণকে ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এ সময়ের মধ্যে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, সোনালী ব্যাংকে হালমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক জালিয়াতি, অগ্রণী ব্যাংকে সানমুন স্টার গ্রুপের জালিয়াতি, জনতা ব্যাংকে ক্রিসেন্ট গ্রুপ জালিয়াতি, ৫টি ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপের জালিয়াতির ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। আবার পুনঃতফসিলের কারণে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র জানা যাচ্ছে না।

নাম না প্রকাশের শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে বাস্তবে খেলাপি ঋণের চিত্র আরও ভয়াবহ। অনেক ব্যাংক খেলাপি ঋণ কম দেখানোর জন্য নিয়মবহির্ভূতভাবে ব্যাংকগুলো ঋণের পুনঃতফসিল করছে। আর এ ক্ষেত্রে ঋণ পুনঃতফসিল নিয়মের মধ্যে করতে না পারলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন নিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে।

এতে করে অনেক ঋণ আদায় না হলেও খেলাপি ঋণের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে না। ফলে আড়ালে থাকছে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র। আর এসব ঋণখেলাপিদের প্রতিহত করতেই মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার।