দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: জেড ক্যাটাগরির কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির আইনেই আছে। এতে তালিকাচ্যুত নয় বরং টানা দুই বছর লভ্যাংশ প্রদানে ব্যর্থ কোম্পানিকে লাভজনক পর্যায়ে উন্নীত করতে নতুন ও পেশাদার নেতৃত্বের হাতে ছেড়ে দিতে বলেছে। নতুন নেতৃত্বও ব্যর্থ হলে অন্য কোনো কোম্পানির সঙ্গে একীভূত করার বা কোম্পানি অবসায়ন (বিক্রি) করে শেয়ারহোল্ডারদের পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ওই আইনে বলা হয়েছে।

১৬ বছর আগের ওই বিধান এখনও কার্যকর করতে পারেনি বিএসইসি। এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংশ্নিষ্টরা বিধানটির বিষয়ে অবগত নন। দুই স্টক এক্সচেঞ্জের শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও এ বিষয়ে ধারণা কম। এ অবস্থায় মন্দ কোম্পানির উদ্যোক্তারা বছরের পর বছর কোম্পানি নিজেদের দখলে রেখে বহাল তবিয়তে আছেন। এতে ঠকছেন সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা। কতিপয় জুয়াড়ি এসব শেয়ার নিয়ে কারসাজি করছে। তাতেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

রুগ্ন কোম্পানির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কমিশনের এ আইনি বিধান বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করেন পুঁজিবাজার সংশ্নিষ্ট এবং বিশ্নেষকরা।

টানা পাঁচ বছর লভ্যাংশ প্রদানে ব্যর্থ কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করার বিষয়ে স্টক এক্সচেঞ্জের বিধানটি শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষায় যথেষ্ট নয় উল্লেখ করে শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, তালিকাচ্যুত করলে মালিকপক্ষই লাভবান হয়। অজ্ঞতা বা আইনি খরচের কারণে মাইনোরিটি শেয়ারহোল্ডাররা আদালতে যান না। তাই এর বিকল্প কিছু থাকা উচিত। অন্য দেশের শেয়ারবাজারে এমন আইন আছে।

বাংলাদেশে এ বিষয়ে আইন হয় ২০০২ সালের ১ আগস্ট। বিএসইসির এ সংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, টানা দুই বছর লভ্যাংশে ব্যর্থ জেড ক্যাটাগরির কোম্পানিকে ছয় মাসের মধ্যে পর্ষদ পুনর্গঠন করতে হবে।

নতুন পর্ষদে উদ্যোক্তা, প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তি শ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অনুপাতে পরিচালক নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তা বা সাবেক পরিচালক বা কোম্পানির সাবেক কর্মকর্তা বা ব্যবসায়িক স্বার্থ সংশ্নিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা তাদের আত্মীয়দের কেউ প্রাতিষ্ঠানিক বা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পক্ষে পরিচালক হতে পারবেন না।

এ ছাড়া কোম্পানির মালিকানায় উদ্যোক্তাদের অংশ ৫০ শতাংশের কম হলে তাদের বাইরে অন্য কাউকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে পেশাদার ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে।

এতে আরও বলা হয়, নতুন পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে কোম্পানিটিকে লাভজনক পর্যায়ে উন্নীত করার রূপরেখা তৈরি করবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করবে। একই সঙ্গে আগে কোম্পানিটি কেন লোকসান করেছে, তা নিরূপণ করবেন এবং এক্ষেত্রে আগের পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনা বিভাগ বা উভয়ের দায় থাকলে তা চিহ্নিত করবে। প্রয়োজনে দায়ীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ আইনি ব্যবস্থা নেবে।

আইনের এ বিধানে আরও বলা হয়েছে, নতুন পর্ষদ দায়িত্ব গ্রহণের ২৪ মাসের মধ্যে কোম্পানির ব্যবসা ও মুনাফা কাঙ্খিত পর্যায়ে উন্নীত করতে ব্যর্থ হলে পরের ছয় মাসের মধ্যে অন্য কোনো লাভজনক কোম্পানির সঙ্গে একীভূত বা অবসায়ন করবে। এ বিধানের নির্দেশনাটি জারির সময় এবং পরে কোনো কোম্পানি জেড ক্যাটাগরিভুক্ত হলে সেগুলোর ক্ষেত্রেও কার্যকর হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

আইনটি কেন এতদিনে কার্যকর হয়নি এ বিষয় জানতে চাইলে কমিশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সবাই জানান, এমন একটি আইন যে আছে, তারা সে বিষয়ে অবগত নন। এমনকি স্টক এক্সচেঞ্জের শীর্ষ কর্মকর্তারাও ওয়াকিবহাল নন।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান বলেন, এমন একটি আইন যে আছে, সেটাই জানতাম না। তবে বর্তমান অবস্থায় আইনটি কার্যকর করা দরকার বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, বিষয়টি কমিশনের নজরে আনা হবে।

বিএসইসির আইন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, কমিশন ১৯৬৯ সালের অধ্যাদেশের ২ সিসি ধারাবলে এ নির্দেশনা জারি করে। বিধানটি জারির পরই তা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকটি কোম্পানি হাইকোর্টে রিট করে। ২০০৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি মো. আবু তারিকের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের তৎকালীন একটি দ্বৈত বেঞ্চ রিটটি খারিজ করে কমিশনের নির্দেশনাকে বৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।

পরে পুনরায় নির্দেশনাটি জারি করেছিল তৎকালীন বিএসইসি। ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর করা হয়। ওই নির্দেশনাবলে খাদ্য খাতের মোনা ফুড নামের একটি কোম্পানি পর্ষদ পুনর্গঠন হয়; কিন্তু একই বছরের ১৭ জুন মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক্ক নামের অপর এক জেড ক্যাটাগরির কোম্পানি পুনরায় এ নির্দেশনাকে চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়ের করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে নির্দেশনাটি তিন মাসের জন্য স্থগিত হয়েছিল।

জানতে চাইলে উচ্চ আদালতে বিএসইসির আইনজীবী প্রবীর নিয়োগী সংশ্নিষ্ট নথি খুঁজে জানান, নথিতে এ রিটের তথ্য থাকলেও পরবর্তী কার্যক্রমের কোনো নথি নেই। এর অর্থ হতে পারে, এরপর আর কোনো শুনানি হয়নি। এ সংক্রান্ত আরও নথি ঘেঁটে তিনি জানান, ২০০৮ সালের জুলাই মাসে মার্ক বাংলাদেশ নামের অপর এক কোম্পানি চেম্বার আদালতে এবিষয়ক হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে; কিন্তু শুনানির পর উচ্চ আদালত স্থগিতাদেশ তুলে নেন। ফলে বিএসইসি চাইলে নির্দেশনাটি কার্যকরে বাধা নেই বলে মত দেন তিনি।

ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, মন্দ কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করা কোনো সমাধান নয়; কিন্তু এর বাইরে স্টক এক্সচেঞ্জের অন্য কিছু করার আইনি ক্ষমতা নেই। এক্ষেত্রে বিএসইসির আইনি ক্ষমতা অগাধ। সংস্থাটিকে শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে আহŸান জানান তিনি।