দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ব্যাংকিং খাতের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও টাকার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের ঋণ কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পথে। এমন পরিস্থিতিতে টাকার সঙ্কট মেটাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিকল্প সুযোগ দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমানতকারীদের আকৃষ্ট করতে ব্যাপক ভিত্তিতে প্রচার প্রচারণার সুযোগ দেয়া হবে।

সুযোগ দেয়া হবে বন্ড ছেড়ে টাকা সংগ্রহের। তবে সব প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দেয়া হবে না। যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো তারাই কেবল এ সুযোগ পাবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নীতিমালা তৈরি করছে। এটি চূড়ান্ত করা হলে তা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য জারি করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবাহ কমে যাচ্ছে। গত ডিসেম্বরে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ শতাংশ, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল সাড়ে ১০ শতাংশ। আমানত প্রবাহ কমে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাতে টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

দৈনন্দিন লেনদেন মেটাতে কলমানি মার্কেটের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলো ধার নিয়েছে ছয় হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত বুধবারই ১৪টি ব্যাংক ধার করেছে দুই হাজার কোটি টাকা। এর পাশাপাশি প্রতিদিন কিছু কিছু ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ধার করে চলছে।

ব্যাংকের পাশাপাশি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও আমানত প্রবাহ কমে যাচ্ছে। সেই সাথে দেখা দিয়েছে টাকার সঙ্কট। জানা গেছে, টাকার সঙ্কটে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ঋণকার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলোতে যে অনিয়ম-দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে, তার প্রভাব আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও পড়েছে।

এমন কমপক্ষে ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোতে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। এতে জড়িয়ে আছে প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালকদের নাম। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধ ডজন আর্থিকপ্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না।

জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রমে আছে। এসব প্রতিষ্ঠান চলতি আমানত, পে-অর্ডার ও চেক ইস্যু করতে পারে না। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসায়ে জড়ানোর সুযোগ নেই তাদের। ব্যাংক থেকে ঋণ ও গ্রাহকদের কাছ থেকে তিন মাসের বেশি মেয়াদি আমানত নিয়ে ঋণ ও লিজ দিতে পারে এসব প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ব্যাংকের তহবিল সঙ্কটের সরাসরি প্রভাব পড়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নানাবিধ সমস্যা দেখা দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এর মধ্যে প্রথম সমস্যা হলো: এসব প্রতিষ্ঠান তিন মাস মেয়াদি আমানত নিয়ে তিন বছর মেয়াদে ঋণ দেয়। ব্যাংকগুলোর ঋণ ও আমানতের অনুপাত কমিয়ে দেয়ার পর অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা তুলে নেয়া হয়। পাশাপাশি অনেক গ্রাহকও টাকা তুলে নেন। এ কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠানের পরিচালকেরাও অনিয়ম করেছেন।

এসব কারণে ব্যাংকের পাশাপাশি দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হয়ে পড়ছে। গ্রাহকেরা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ ও লিজ-সুবিধা নিয়ে তা ফেরত দিচ্ছেন না। নিয়মকানুনে অনেকটা ছাড় থাকায় ব্যাংকের চেয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যবসার বেশি সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষ করে শতভাগ ভোক্তাঋণ দিতে পারছে এসব প্রতিষ্ঠান।

অন্য দিকে, ব্যাংকগুলো শতভাগ ভোক্তাঋণ দিতে পারে না। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ফারমার্স ব্যাংকের কারণে যেমন নতুন ব্যাংকের ওপর কিছুটা আস্থার সঙ্কট দেখা দিয়েছিল, তেমনি হাতে গোনা চার-পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর কিছুটা আস্থার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফলে সামগ্রিক প্রভাব আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরেও পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কী মানের, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সালের ১৭ জুন বিশেষ সফটওয়্যার চালু করে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর মতো এসব প্রতিষ্ঠানকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। প্রথম তালিকার প্রতিষ্ঠানগুলো থাকছে সাধারণ শ্রেণীতে। এর পরের ধাপের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হচ্ছে দুর্বল।

আর তৃতীয় ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। গত বছরের বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী: প্রথম ক্যাটাগরিতে পাঁচটি, দ্বিতীয় ধাপে ১৭টি ও তৃতীয় ধাপে ১২টি প্রতিষ্ঠান ছিল। তবে এই খাতে সবই খারাপ নয়। আইডিএলসি, আইপিডিসি, উত্তরা ফাইন্যান্স, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স ও আইআইডিএফসির মতো বেশ কিছু ভালো প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলোর আর্থিক সঙ্কট মেটাতে নানাভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে। তেমনিভাবে ভালো মানের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও বিশেষ কিছু সুযোগ দেয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও বন্ড ছাড়ার অনুমোদন দেয়া হবে। ব্যাংকগুলো বাজারে বন্ড ছেড়ে মূলধন সংরক্ষণ করে। ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও এ সুযোগ দেয়া হবে।

এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়ার শর্ত কিছুটা শিথিল করা হবে। একই সাথে বিদ্যমান নীতিমালার মধ্যেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে বেশি পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করতে পারে সে জন্য প্রচার-প্রচারণা চালানোর বিশেষ সুযোগ দেয়া হবে। টাকার সঙ্কট মেটাতে আরো বিশেষ কিছু সুযোগ দেয়া হবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এ ব্যাপারে নীতিমালা চূড়ান্ত হলে তা শিগগিরই জারি করা হবে।