দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন বছরের শুরু থেকেই দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগে ইতিবাচক ধারা দেখা গেছে। স্থানীয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ তলানিতে নেমে এলেও বিদেশিদের নিট বিনিয়োগ বাড়তে দেখা গেছে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে পুঁজিবাজারে বিদেশিদের পোর্টফোলিও বিনিয়োগ বেড়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

এর মধ্যে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন সিকিউরিটিজে ফেব্রুয়ারীতে ৩২৩ কোটি টাকারও বেশি নিট বিনিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি কোম্পনিতে বিদেশী বিনিয়োগের হিড়িক পড়েছে। ফেব্রুয়ারীতে যেসব শেয়ারে বিদেশিদের বিনিয়োগ আগ্রহ ছিল, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: গ্রামীণফোন, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, ব্র্যাক ব্যাংক, আইপিডিসি,

বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, সিঙ্গার, অলিম্পিক, পাওয়ার গ্রিড, পূবালী ব্যাংক, সিটি, ইবিএল, ইসলামী ব্যাংক, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ, রেনাটা, ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, সামিট পাওয়ার ও ডরিন পাওয়ার। এর মধ্যে বিদেশিরা সবচেয়ে বেশি লেনদেন করেছে গ্রামীণফোন, স্কয়ার ফর্মাসিউটিক্যালস ও ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কায় গত বছর পুঁজিবাজার থেকে প্রায় ৪৯৩ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয় বিদেশিরা। তবে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করায় পুঁজিবাজারে তাদের বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারীতে বিদেশিরা মোট ৮৫১ কোটি টাকার লেনদেন করেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন ৫৮৭ কোটি ১৫ লাখ টাকার।

বিপরীতে বিক্রি করেছেন ২৬৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকার শেয়ার। এ হিসেবে ফেব্রুয়ারীতে তাদের নিট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৩২৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিদেশিদের নিট বিনিয়োগ ছিল ১৭৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ২০০৪ সাল থেকে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশিদের নিট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে ডিএসইর মোট লেনদেনের মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ আসে বিদেশিদের শেয়ার কেনাবেচা থেকে; যেটা ভারতে প্রায় ৩০ শতাংশের বেশি।

২০১৮ সালে বাংলাদেশের সমকক্ষ উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বাজে অবস্থা ছিল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই)। এ সময় ডিএসইর সূচক কমে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ। সেখানে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ভারত ও শ্রীলঙ্কা ৫ থেকে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ মূল্যসূচক হারায়।

গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৪৯৩ কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়। যুক্তরাষ্ট্রে সুদহার বৃদ্ধির কারণে উদীয়মান অর্থনীতির বিভিন্ন দেশ থেকেও বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়। এসব দেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের আরেকটি কারণ ছিল স্থানীয় নির্বাচন। বাংলাদেশে এটি হয়ে যাওয়ার পর থেকে গত দুই মাসে বিদেশিদের বিনিয়োগ বাড়ছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে পুঁজিবাজার সংশোধন হওয়ায় অধিকাংশ শেয়ার দর বিনিয়োগ অনুক‚লে ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিদেশিরা সে সুযোগে শেয়ার কেনার পরিমাণ বাড়িয়েছেন। ২০১৮ সালে কিছু বিনিয়োগ প্রত্যাহার হলেও ২০১৭ সালে বিদেশিরা ১ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা নিট বিনিয়োগ করেন।

জানা গেছে, দেশের শেয়ারবাজারে যেসব বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে তাদের সিংহভাগই যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিনিয়োগ কোম্পানি। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর, দুবাইভিত্তিক কিছু বিনিয়োগ কোম্পানিরও বিনিয়োগ রয়েছে। নর্ডিক দেশগুলোর ব্যবসায়ীদের সমন্বিত বিনিয়োগ কোম্পানি ব্রামার্স অ্যান্ড পার্টনার্স দেশের পুঁজিবাজারে প্রায় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১০ সালের বাজার ধসের পরের বছর থেকে বিদেশি বিনিয়োগের উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নিট বিনিয়োগে ইতিবাচক ধারা ছিল। এ সময় টানা সাত বছরে বিদেশিরা আট হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা নিট বিনিয়োগ করেছেন। টানা বিনিয়োগের পর ২০১৮ সালে বিনিয়োগ কিছুটা প্রত্যাহার করে নেন তারা।

২০১৮ সালে বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সঙ্গে নির্বাচনের সংযোগ ছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ঝুঁকির বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলো ছাড়াও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর অধিকাংশই স্থানীয় মুদ্রার মান কমিয়েছে বা অবমূল্যায়ন করেছে।

তবে বাংলাদেশে কিছুটা অবমূল্যায়ন হলেও এখনো বিদেশি মুদ্রার বিপরীতে টাকার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে। গত সাত বছরে ভারত ও পাকিস্তান তাদের নিজস্ব মুদ্রার ৫০ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়ন করেছে। টাকার অবমূল্যায়ন হলে বিদেশিরা আরও বেশি বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন বলে জানান বিদেশি পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তারা।