দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিমান খাতের একমাত্র কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক সংকটে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি এখন নামেই বেঁচে আছে। টানা ৬ বছর কোম্পানির সব ফ্লাইট সার্ভিস বন্ধ। কোম্পানির ১১টি উড়োজাহাজ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিমান বন্দরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। শীর্ষ ঋণ খেলাপির তালিকায় এখন এ প্রতিষ্ঠানটি। বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কাছে প্রতিষ্ঠানটির ২শ’ কোটি টাকার বেশি বকেয়া রয়েছে। এসব কারণে

বর্তমানে এই কোম্পানির ১০ টাকার শেয়ার দুই টাকায়ও কিনছেন না বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিটি কোম্পানির উদ্যোক্তাদের সম্মিলিতভাবে নিজ কোম্পানির ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাদকতা থাকলেও এ প্রতিষ্ঠানের রয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরই ৭০ শতাংশের ওপরে।

অর্থাৎ এই প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনে পথে বসেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। সা¤প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে ৩০টি দুর্বল কোম্পানির তালিকা করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এরমধ্যে অন্যতম ইউনাইটেড এয়ার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দুর্বল এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

এ বিষয় জানতে চাইলে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কোম্পানিটির অবস্থা ভালো না। দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেয়া উচিত। তিনি বলেন, সিকিউরিটিজ আইনে অধিগ্রহণের সুযোগ থাকলে কোম্পানির সম্পদ বিক্রি করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) বিনিয়োগকারীদের টাকা পরিশোধ করতে হবে। বর্তমান আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় কোম্পানি আইনে তার দেউলিয়াত্ব প্রমাণ হলে বিনিয়োগকারীরা আদালতে যেতে পারেন।

ব্যবস্থাপনা সংকট: ব্যবস্থাপনা সংকটে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের সব ধরনের ফ্লাইট সার্ভিস বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর আগে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে পদত্যাগ করেন কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন (অব.) তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী। ওইদিনই মোহাম্মদ মাহাতাবুর রহমানকে চেয়ারম্যান ও শাহিনুর আলমকে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়।

কিন্তু নতুন পর্ষদের অধীনে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে পরের দিনই পাইলটসহ এয়ারলাইন্সটির ২০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্ম বিরতিতে যান। এরপর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হয়। পরবর্তীতে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি কোম্পানিটি। জানতে কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। অন্য একটি সূত্র বলছে, দীর্ঘদিন থেকে তিনি দেশের বাইরে।

আর্থিক সংকট : বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৩শ’ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দীর্ঘদিনেও কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না। এছাড়া বেবিচকের কাছে বকেয়া রয়েছে ২শ’ কোটি টাকার বেশি। ভারত, মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ বিশ্বের যে সব দেশে আগে বিমান চলাচল করেছে, সে সব দেশের বিমান বন্দরেও বকেয়া রয়েছে। এমনকি এয়ারলাইনসের পাইলট ও ক্রুরা দেশগুলোর যে সব হোটেলে ছিল ওই হোটেলের বিলও বকেয়া রয়েছে। তারা বাংলাদেশ সরকারকে বিভিন্ন সময়ে টাকার জন্য চিঠি দিয়েছে।
সূত্র বলছে, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের চেয়ে ঋণ বেশি।

কোম্পানি বন্ধের কমপক্ষে দুই বছর আগে থেকেই প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছিল। পুরনো উড়োজাহাজ ব্যবহারের কারণে জ্বালানি খরচ বেশি। বিলম্বিত কর আমলে নেয়ার পর থেকেই মুনাফা কমে গেছে প্রতিষ্ঠানটির। এর আগে শেয়ারবাজার থেকে রাইট শেয়ার ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করে উড়োজাহাজ কেনা হলেও প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়নি।

বরং বেশি দামে উড়োজাহাজ কেনার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। এরপর আর্থিক সংকট কাটাতে নতুন করে রাইট শেয়ার ছাড়তে চেয়েছিল তারা। কিন্তু উদ্যোক্তাদের ৩০ শতাংশ শেয়ার না থাকায় অনুমতি দেয়নি বিএসইসি। বিপরীতে ২০১৬ সালে কোম্পাটিকে ২২৪ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করার অনুমোদন হয়।

পুঁজিবাজার: ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন ৮২৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ৭০ দশমিক ৩৬ শতাংশ বা ৫৮২ কোটি টাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ১৩ দশমিক ০৩ শতাংশ,

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ১২ দশমিক ১৮ এবং উদ্যোক্তাদের ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ। কিন্তু বিএসইসির নিয়মানুসারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তাদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাদকতা রয়েছে। কোম্পানির ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ারের সর্বশেষ মূল্য ২ টাকা ৬০ পয়সা। ২০১৩-২০১৪ সালে এই কোম্পানির শেয়ারের দাম ছিল ২০ টাকার ওপরে।

এ বিষয় জানতে চাইলে ডিএসইর পরিচালক মো. রকিবুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন থেকে এ ধরনের কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের কোনো ধরনের লভ্যাংশ দেয় না। এতে বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্ত হচ্ছে। ফলে তদন্ত করে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো ঠিকমত তাদের দায়িত্ব পালন না করলে বাজার টেকসই হবে না।