দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বড় গ্রাহকদের কাছে ঋণ দিয়ে ফেরত পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। আর এ কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে দেয়া বড় অঙ্কের ঋণের বেশির ভাগই কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে কিছু শিল্প গ্রুপের হাতে। এমনকি বিশেষ সুবিধায় নবায়ন করা ১১টি শিল্প গ্রুপও তাদের ঋণ পরিশোধ করছে না। এতে ব্যাংকিং খাতে পুঞ্জিভূত খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর লোকসানের পাল্লা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে বড় অঙ্কের ঋণের সংজ্ঞায়, কোনো ব্যাংকের মোট মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি কোনো গ্রাহককে ঋণ দিলেই তা বড় অঙ্কের ঋণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ বড় অঙ্কের ঋণ কোনো ব্যাংক একজন গ্রাহককে দিতে চাইলে আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হতো। এর ফলে কোনো ব্যাংক কী পরিমাণ বড় অঙ্কের ঋণ দিচ্ছে সে সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবহিত থাকত।

কিন্তু মুক্তবাজারের নামে একপর্যায়ে এ বিধান তুলে দেয়া হয়। তখন থেকে ব্যাংকগুলো কোনো গ্রাহককে বড় অঙ্কের ঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর অনুমোদন নিতে হয় না। ব্যাংকগুলো নিজেরাই ব্যাংক গ্রাহকের সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ দিয়ে আসছে। তবে একক ঋণের সীমা অর্থাৎ কোনো ব্যাংকের মোট মূলধনের ১৫ শতাংশের বেশি কোনো একজন গ্রাহককে নগদ দিতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ সুযোগে ব্যাংকগুলোতে জালিয়াতি বাড়তে থাকে। ব্যাংকগুলো অনেকটা ফ্রি স্টাইলে গ্রাহকদের ঋণ দিতে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ঋণ রাজনৈতিক চাপ, স্বজনপ্রীতি, পরিচালনা পর্ষদের হস্তক্ষেপে বিতরণ হয়েছে। এ কারণেই হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, এননটেক্স, ক্রিসেন্ট লেদার, বেসিক ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংকের মতো (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে ব্যাংকিং খাতে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, উদ্দেশ্য ছিল বিশেষ সুবিধা দিয়ে ঋণ পুনর্গঠনের মাধ্যমে শিল্পগুলোর লোকসান কাঠিয়ে উঠবে। একই সাথে প্রতিষ্ঠানগুলো চালু রেখে আয় উপার্জনের মাধ্যমে ঋণের অর্থ পরিশোধ করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা নেয়ার পর প্রতিষ্ঠানগুলো তা পরিশোধ করছে না। যে পরিমাণ ঋণ পুনর্গঠন করেছিল তার কিস্তি পরিশোধ না করায় সুদে-আসলে তা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, উচ্চ আদালত থেকে খেলাপি ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে বড় বড় গ্রুপগুলো অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নিচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, মাত্র ১ ও ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এবং সুদের ওপর বিশেষ ছাড় নিয়ে ১১টি শিল্প গ্রুপ ১৪ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেছিল। ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় ওই ঋণ আবার খেলাপি হয়ে পড়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে ওই ঋণ সুদে-আসলে এখন ২০ হাজার কোটি টাকা ছেড়ে গেছে, যা গত সেপ্টেম্বর শেষে ছিল প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। ২৪টি ব্যাংক থেকে এ সুবিধা নিয়েছিল শিল্পগ্রুপগুলো।

ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংকগুলো এখন চরম বেকায়দায় পড়ে গেছে। ব্যাংকগুলোর পুঞ্জিভূত খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এতে ব্যাংকের মুনাফা থেকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে ব্যাংকের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, অবলোপন বাদেই শুধু সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঋণ পুনর্গঠন করা ২৪ ব্যাংকের একটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জানিয়েছেন, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে প্রভাবশালী এ শিল্পগ্রুপগুলোর বিশেষ সুবিধায় ঋণ নবায়ন করা হয়েছিল। সাধারণত ঋণ নবায়ন করতে পুঞ্জিভূত খেলাপি ঋণের ১৫ শতাংশ নগদে ডাউন পেমেন্ট দিতে হয়। কিন্তু ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে ১ ও ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নিয়ে এবং ঋণ মঞ্জুরির সময় ধার্যকৃত সুদে বিশেষ ছাড় দিয়ে ঋণ নবায়ন করা হয়েছিল। ওই সময় ব্যাংকের প্রকৃতপক্ষে ক্ষতি হলেও আশা করা হয়েছিল বিশেষ সুবিধা নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করবে।

কিন্তু বাস্তবে ঠিক উল্টোটি হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বিশেষ সুবিধা নিয়ে ঋণ পুনর্গঠন করে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছে না। উল্টো তাদের খেলাপিও বলা যাবে না। কেউ কেউ উচ্চ আদালত থেকে স্থাগিতাদেশ নিয়েছে। উচ্চ আদালত থেকে রিট নিয়ে আবার অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। অথচ ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ঋণখেলাপি গ্রাহক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন না। অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আবার তারা খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই ব্যাংকিং খাতকে তারা জিম্মি করে ফেলছেন।

ব্যাংকগুলো থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকার সমর্থিত দেশের প্রভাবশালী একটি শিল্পগ্রুপ ২০১৫ সালে বিশেষ সুবিধায় ৫ হাজার ২১৬ কোটি টাকার ঋণ নবায়ন করেছিল। ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় ওই ঋণ বেড়ে এখন সুদে-আসলে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার ওপরে ঠেকেছে।

অপর একটি শিল্পগ্রুপ ১ হাজার ৭৭৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেছিল। ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় সুদে-আসলে তা বেড়ে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকায় উঠেছে। দেশের প্রথম কাতারের আরেকটি শিল্পগ্রুপ ১ হাজার ৬৮৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেছিল। যথাযথভাবে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় এখন তা বেড়ে প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকায় ঠেকেছে। আরেকটি শিল্প গ্রুপ ১ হাজার ১৫২ কোটি ৭৫ লাখ টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেছিল। ওই ঋণ এখন বেড়ে হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। সাম্প্রতিককালে বহুল আলোচিত রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির দায়ে অভিযুক্ত আরেকটি শিল্প গ্রুপ ১ হাজার ৯৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকার ঋণ পুনর্গঠন করেছিল। যথাযথভাবে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় এখন তা বেড়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

পুনর্গঠন করা ষষ্ঠ অবস্থানে থাকা আরেকটি শিল্প গ্রুপের ৮৭৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। আলোচিত এ প্রতিষ্ঠানটির বকেয়া ঋণ বেড়ে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকায় ঠেকেছে। সপ্তম অবস্থানে থাকা একটি শিল্প গ্রুপের ৮১১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু ওই ঋণ এখন বেড়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকায় ঠেকেছে।

পুনর্গঠনের সুবিধা নেয়া নবম স্থানে থাকা একটি শিল্প গ্রুপের ৫৯৪ কোটি ১১ লাখ টাকার ঋণ যথাযথভাবে পরিশোধ না করায় তা বেড়ে এখন সাড়ে ৭০০ কোটি টাকার ওপরে ঠেকেছে। ১১তম স্থানে থাকা আরেকটি শিল্প গ্রুপের ৫২২ কোটি ৯৮ লাখ টাকার ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় এখন সুদে-আসলে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা।

বিশ্লষকেরা জানিয়েছেন, বড় গ্রাহকদের সব ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে দেয়া উচিত নয়। ব্যাংকগুলো সবাই মিলে একই গ্রাহককে ঋণ দিচ্ছে, ফলে গ্রাহকের ঋণের পরিমাণ বেশি হয়ে যাচ্ছে। এতে ব্যাংকের ঝুঁকি বাড়ছে। ঋণ কেন্দ্রীভূত হওয়া ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ নেয়া উচিত। একই সাথে বড় শিল্প গ্রুপের ঋণগুলো কঠোরভাবে তদারকি করা উচিত। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রেও নজরদারি বাড়ানো উচিত।