ফাতিমা জাহান, আবদুর রাজ্জাক, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নানা উদ্যোগের পরও পুঁজিবাজারে আসেনি সরকারি মালিকানাধীন বিভিন্ন কোম্পানি। অভিযোগ রয়েছে তালিকাভুক্তিতে ধীরগতির পিছনে অজানা শক্তি সবসময় কাজ করেছে। তবে লাল ফিতার দৌরাত্মকে দায়ী করেছেন অনেকেই। সরকারি মোট ২৫টি কোম্পানির পুঁজিবাজারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২০১০ সালে।

দীর্ঘ নয় বছর প্রচেষ্টায় অবশেষে দেশের পুঁজিবাজারে আসছে সরকারি মালিকানাধীন ১৫ কোম্পানি। এবার লাভজনক করে এসব কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনতে আঁটঘাট বেঁধে নেমেছে সরকার। এক্ষেত্রে ভালো ও লাভজনক কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

এদিকে চলতি বছরেই কয়েকটি সরকারি কোম্পানির শেয়ার বাজারে আসতে পারে। এর মধ্যে কোনো কোনো কোম্পানি আইপিও’র মাধ্যমে বাজারে শেয়ার ছাড়তে পারে। আবার কোনোটি ডাইরেক্ট লিস্টিং এর মাধ্যমে আসতে পারে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড কমিশনের (বিএসইসি)কমিশনার ড. স্বপন কুমার বালা এই তথ্য জানিয়েছেন। গত শনিবার বিকালে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে ক্যাপিটাল মার্কেট এক্সপো ২০১৯ সমাপনী দিনে দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নে পুঁজিবাজারের ভূমিকা শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

স্বপন কুমার বালা বলেন, সরকারী কোম্পানি বাজারে আনার বিষয়ে বাধ্য করা যায় কিনা তা নিয়েও ভাবা হচ্ছে। তারা সরাসরি হোক বা আইপিওর মাধ্যমে হোক বাজারে আসবে। সম্প্রতি কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে শেয়ার ছাড়তে বলা হয়েছে।

এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে দেওয়া হয়েছে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরির নির্দেশনা। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর সম্পদ দ্রুত পুনঃমূল্যায়ন করার কথা বলা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ঐ বৈঠকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। অর্থ বিভাগের অতিরিক্তি সচিব মো. এখলাছুর রহমানের সভাপতিত্বে বৈঠকে সরকারি ১৫ কোম্পানির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

সূত্র মতে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুসলিম চৌধুরীর নেতৃত্বে গত বছরের জুলাইয়ে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয় সরকারি কোম্পানিগুলোর শেয়ার ছাড়ার অগ্রগতি পর্যালোচনায়। প্রতি দুই মাস পর কমিটি বৈঠক করেছে। এই কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন: পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, জ্বালানি মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ ও বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন বা আইসিবির প্রতিনিধি। সূত্র বলেছে, এ সব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা উন্নতির জন্য প্রয়োজনে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা বরাদ্দ দেওয়ার কথাও রয়েছে।

রাষ্ট্রয়াত্ব লিমিটেড কোম্পানিগুলোর শেয়ার পুঁজিবাজারে অফলোড করার বিষয়ে নড়েচড়ে বসেছে সরকার। নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা যায়, পুঁজিবাজারে সরকারি লিমিটেড কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশনা রয়েছে। এর অংশ হিসেবে অনেকদিন আলোচিত হওয়ার পর এবার একত্রে বসতে যাচ্ছে অর্থমন্ত্রনালয়।

একই টেবিলে সব কোম্পানিকে নিয়ে ক্রমান্বয়ে তাদের তালিকাভুক্ত করা উদ্যোগ নেওয়া হবে। যেসব কোম্পানি ইতিমধ্যে তালিকাভুক্ত হয়েছে তাদের শেয়ার নতুন করে অফলোড করার সুযোগ থাকলে সে উদ্যোগও নেওয়া হবে।

জানা যায়, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে নতুন করে অর্থ উত্তোলনের যোগ্যতা কেবলমাত্র পাওয়ার গ্রিডের রয়েছে। এছাড়া তিতাস এবং ডেসকো আলোচনায় থাকলেও অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো নেগেটিভ থাকায় এখনি তাদের তালিকাভুক্ত করা যাচ্ছে না। বিদ্যমান সিকিউরিটিজ আইনের অধীনে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির শেয়ার অফলোড করা সম্ভব। তাই ইতিমধ্যেই পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির শেয়ার অফলোড করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি সরকারি কোম্পানিগুলোর মধ্যে আইপিও’র মাধ্যমে ২০১২ সালে বাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বিনিয়োগকারীদের দাবী এবং বিশ্লেষকদের অভিমত থাকলেও বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আর কোনো সরকারি কোম্পানি তালিকাভুক্ত বা শেয়ার অফলোড করেনি।

এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির কোম্পানি সচিব মো. শাহজাহান বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত আমরা এ ধরনের কোনো চিঠি পাইনি। পেলে জানাতে পারব’। একাধিক সরকারি কোম্পানির নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে মন্ত্রনালয়ে তাদের শেয়ার অফলোড নিয়ে জরুরী সভায় ডাকা হয়েছে।
এ বিষয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতায় সরকারি কোম্পানিগুলোর আন্তরিকভাবে তালিকাভুক্ত হওয়া উচিত। উদ্যোগ নেওয়া হলেও সরকারি আন্তরিকতার অভাবে কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করা যায়নি’।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সরকারি কোম্পানি রয়েছে ১৬টি। এর বাইরেও বেশকিছু কোম্পানির শেয়ার রাষ্ট্রের মালিকানায় রয়েছে। তালিকাভুক্ত ১৬ কোম্পানির অধিকাংশেরই ব্যবসায়িক পরিস্থিতি ইতিবাচক নয়। নতুন চুক্তি কিংবা ফান্ডের খবরে এসব কোম্পানির শেয়ারদরে বড় ধরনের ওঠা-নামা হয়েছে চলতি বছরের শুরুতেই। বাজারে মৌলভিত্তির শেয়ার হিসেবে পরিচিত এসব কোম্পানির খুব বেশি শেয়ার বাজারে না থাকায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাও অল্পকিছু শেয়ারের দিকেই ঝুঁকছেন।

তাই প্রধানমন্ত্রীর নিদের্শনায় এবার সরকারি শেয়ার অফলোডে উদ্যোগী হচ্ছে অর্থমন্ত্রনালয়। এর আগে ২০০৭ সালে তত্ত¡াবধায়ক সরকার দায়িত্বে আসার পর পুঁজিবাজারে সরকারি কোম্পানিগুলোর শেয়ার অফলোডের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির জন্য সে সময় প্রথমে ২৪টি সরকারি কোম্পানির তালিকা তৈরি হয়। পরবর্তীতে এ সংখ্যা ৩২ এ উন্নীত করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অফলোড নিয়ে একাধিকবার নির্দেশনা দিয়েছেন।

ওই সময় কোম্পানিগুলোকে ২০১০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেয়ার ছাড়তে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১১ সালের ১০ ফ্রেবুয়ারী আরেকটি বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা জানিয়ে কোম্পানিগুলোকে শেয়ার ছাড়ার তাগিদ দেয়া হয়। এর মধ্যে কয়েকটি কোম্পানির সময়সীমা ২০১১ সালের ১৪ ও ৩০ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবে এ সময়ে মোট কোম্পানির সংখ্যা ৩৪ থেকে কমে দাঁড়ায় ২৬ এ।

সর্বশেষ শেয়ার ছাড়ার জন্য গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পযন্ত সময়সীমা বাড়ানো হয়। এর মধ্যে গত ছয় বছরে যমুনা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টস, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন, রুপালী ব্যাংক ও সাবমেরিন কেবল কোম্পানি এ ছয়টি কোম্পানি শেয়ার অফলোড করতে পেরেছে। বাকি ২০টি কোম্পানিই শেয়ার ছাড়তে ব্যর্থ হয়েছে।

এর আগে, ২০১২ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে সরাসরি তালিকাভুক্তির অনুমোদন পাওয়ার পরও নানা জটিলতায় রাষ্ট্রায়াত্ত এসেনসিয়াল ড্রাগস পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারেনি। লাভজনক হলেও কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সমন্বয়হীনতা, ধীরগতি, সম্পদ পুনর্মূল্যায়নে কালক্ষেপণ, নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে কম শেয়ার ছাড়ার প্রস্তাব, স্টক এক্সচেঞ্জে সরাসরি তালিকাভুক্তির অনুমোদনের পর নতুন করে মূলধন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে এসেনসিয়াল ড্রাগসের শেয়ার ছাড়ার প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে।

একই পরিস্থিতি সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। এর আগে রাষ্ট্রয়াত্ত প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক অস্বাভাবিক প্রিমিয়াম দাবি করে শেয়ার ছাড়ার আবেদন জানিয়েও পরবর্তীতে পিছিয়ে পড়ে। এসব কারণেই সরকারের নীতিনির্ধারকরা বারবার ঘোষণা দিলেও প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই নির্ধারিত সময়ে শেয়ার ছাড়তে ব্যর্থ হয়।