আবদুর রাজ্জাক, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারের স্বার্থে ৫টি মূলনীতি নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হলেও সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি’)’র ভূমিকা নিয়ে সন্দিহান বিনিয়োগকারীরা। দেশের পুঁজিবাজারে একাধিকবার অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলেও পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় আইসিবির ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা।

বিশেষ করে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম দায়িত্ব হলেও দীর্ঘ নয় বছরেরও অধিক সময় ধরে সঙ্কট উত্তরণে আইসিবির তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই।  আর আইসিবি অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করলে সম্প্রতি পুঁজিবাজারের নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। প্রতি অর্থবছরে ঈর্ষণীয় মুনাফা করলেও পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

তাছাড়া পুঁজিবাজার উন্নয়ন এবং তারল্য প্রবাহ স্থিতিশীল রাখতে ২০১৮-২০১৯ হিসাব বছরে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে কর্মসম্পাদন চুক্তি হয়। কিন্তু এই হিসাব বছরের প্রথম অর্ধে চুক্তিতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি আইসিবি।

জানা যায়, আইসিবির ৫টি মূলনীতির মধ্যে রয়েছে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি, পুঁজিবাজারের উন্নয়ন, সরবরাহ বৃদ্ধি এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, সঞ্চয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং ব্যবসায়িক উন্নয়নে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা।

একাধিক বিনিয়োগকারীরা বলছেন, মূলনীতির কোনোটাই যথাযথ পালন করে না আইসিবি। যদি নিয়মানুযায়ী আইসিবি কর্তৃপক্ষ কর্মকান্ড পরিচালনা করত তবে বাজারে কোনোভাবেই এমন নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। সম্প্রতি আইসিবির শেয়ার বিক্রির কারনে বাজারে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি।

তাদের মতে, বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণের বিষয়ে আইসিবির তেমন কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যায় না। এছাড়া বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিষয়টিও বিনিয়োগকারীদের জানার বাইরেই থেকে যায়। সরবরাহ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বিনিয়োগকারীরা আইসিবির ভূমিকাকে বড় করে দেখতে চান না। কারণ দীর্ঘ নয় বছরেও আইসিবি সরকারি ২৩ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বাজারে যুক্ত করতে পারেনি।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আইসিবির মাধ্যমে বাজারের নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়। কিন্তু বাস্তবে বাজারের নিয়ন্ত্রণ খেলোয়াড়দের হাতেই রয়ে গেছে। তাই আইসিবি অর্পিত দায়িত্ব পালনে কতটুকু সফল তা পর্যালোচনার বিষয়। তাছাড়া আইসিবিকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য। বাজার যখন নিন্মগতির দিকে থাকবে, তখন তাকে স্থিতিশীল রাখা আইসিবির কর্তব্য।

কিন্তু আইসিবি সেটি না করে শুধু শেয়ার বিক্রি করে কিন্তু এই শেয়ার বিক্রির টাকা কোথায় যাচ্ছে? আসলে আইসিবির বিষয়ে বিএসইসি কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কারণ আইসিবি সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। অর্থ মন্ত্রণালয় জানে না আইসিবি কোন শেয়ার কত টাকায় কিনছে। এখানেই কারসাজিটি বেশি হচ্ছে বলে তারা মনে করেন।
একাধিক বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, আইসিবি নিজে মুনাফা করতে ব্যস্ত।

যে কারণে বাজারকে সাপোর্ট দিতে এ প্রতিষ্ঠান তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। যাও রাখে তা দায়সাড়া। যে কারণে ২০১০ সালের ভয়াবহ ধসের পর দীর্ঘ আট বছরের ও বেশি সময় বাজার নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তারা আইসিবিরি ভূমিকা তদারকির জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক সাব্বির আহমেদ বলেন, জানুয়ারিতে পুঁজিবাজারে ইতিবাচক গতি দেখা গিয়েছিল। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল থাকায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও চাঙাভাবে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এখন সে অবস্থা দেখা যাচ্ছে না। যে কোনো কারণেই হোক, বাজারে এখন খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে।

এটি আসলে বিনিয়োগকারীকে বিব্রত করছে। এখন দেশের অর্থনীতির সব সূচক মোটামুটি ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে। গত সপ্তাহে দেশের জিডিপি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক প্রকাশ করেছে সাত দশমিক দুই। শেষ ১০ বছরে জিডিপি ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির বিভিন্ন খাত উন্নতি করলেও বাজার তার দৈন্য কাটিয়ে উঠতে পারছে না। গত দু’মাস ধরে বাজারের যে অবস্থা, তা বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করেছে। এর পেছনে অদৃশ্য কোনো হাত রয়েছে বলে মনে করি।

তিনি আরও বলেন, কয়েক বছর ধরে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এ জন্য অনেকেই ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কথা ভাবছেন। পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রেও একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন দরকার। যেখানে বাজার-সংশ্লিষ্ট বিএসইসি, ডিএসই, সিএসই, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং অডিট ফার্ম প্রভৃৃতির অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা থাকবেন।

তারা বাজার নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখবেন কেন বাজারমুখী হচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। আবার দ্রুত কিছু কোম্পানির শেয়ার কারণ ছাড়াই বাড়তে থাকে বা কমে। এসব বিষয় নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণের জন্য কমিশন গঠন করার সময় এসেছে। এতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা বেরিয়ে আসবে।

ড. মো. নুরুল আজাহার বলেন, আসলে বাজারের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। অবশ্য বাজার এরকম থাকার বিশেষ কিছু কারণও রয়েছে। বাজার থেকে বিভিন্ন কৌশলে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। আর এর শিকার হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারী। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এ বিষয়গুলো ভালো করে খতিয়ে দেখতে হবে। বিশ্বের সব পুঁজিবাজারেই কম-বেশি কারসাজি হয়।

যেমন কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম ফেসভ্যালুর নিচে, ইপিএস নেগেটিভ; আবার কোম্পানির কারখানা বন্ধ থাকে। কিন্তু ওইসব কোম্পানির শেয়ারের দাম কীভাবে বাড়ে। আসলে এখানে কারসাজি করে একটি চক্র দাম বাড়িয়ে দেয়। বিষয়টি বাজারের জন্য সবচেয়ে খারাপ। এটি কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় তা অচিরেই ভাবতে হবে। আবার আইসিবিকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য। বাজার যখন নি¤œগতির দিকে থাকবে, তখন তাকে স্থিতিশীল অবস্থানে রাখা আইসিবির কর্তব্য।

কিন্তু আইসিবি সেটি না করে শুধু শেয়ার বিক্রি করে কিন্তু এই শেয়ার বিক্রির টাকা কোথায় যাচ্ছে? আসলে আইসিবির বিষয়ে বিএসইসি কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কারণ আইসিবি সরকারি তথা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। অর্থ মন্ত্রণালয় জানে না আইসিবি কোন শেয়ার কত টাকায় কিনছে। এখানেই কারসাজিটা বেশি হয়। গত বছর দুদক বাজারে কারসাজির কারণে আইসিবির কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। কিন্তু সেসব ব্যক্তির নামমাত্র বিচার হয়েছে। এমন হলে বাজারে আরও কারসাজির সুযোগ তৈরি হবে।

স¤প্রতি ডেইলি স্টারের সাংবাদিক সাজ্জাদুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজার একটি সংবেদনশীল জায়গা। এখানে আইসিবিকে গঠন করার উদ্দেশ্যেই হচ্ছে তারা পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আইসিবি কি সে ভুমিকা পালন করছে কি না। আমার মতে দেশের বাজারে আইসিবি সবচেয়ে বড় প্লোয়ার বা ম্যাকার বা গ্যাম্বলার-যা-ই বলুন না কনে। এখানে ব্যক্তি বা কোনো প্রতিষ্ঠান আইসিবির ধারে কাছেও নেই। আর আইসিবির গম্বেলিং করা মানে সরকাররে গ্যাম্বিলং করা। দেশের অর্থনীতির সব সূচকই এখন ভালো, তার পরও বাজাররে এমন অবস্থা আসলে চিন্তার বিষয়।

আইসিবি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরী দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দেয়ার জন্যই আইসিবির জন্ম। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর নিজের মুনাফা বাড়াতে ব্যস্ত থাকে। তারা পুঁজিবাজারে যথাযথ ভূমিকা পালন করছে না। রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা চরম ক্ষুদ্ধ। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে আইসিবিকে বিনিয়োগে আসতে হবে। পাশাপাশি স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে পুঁজিবাজারে কত টাকা বিনিয়োগ করেছে এটিও প্রকাশ করা উচিত।

অর্থনীতিবিদদের মতে, পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনয়নে আইসিবির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা। সে হিসেবে নিজস্ব তহবিল থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগ করলে বাজার ইতিবাচক ধারায় অনেক আগেই ফিরত। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ বিনিয়োগকারীর ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে।

এতে করে নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ সুদসহ ঋণ পরিশোধ করার কারণে বাজারে দরপতনের ধারা ত্বরান্বিত হয়। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা সঙ্কট থেকেই যাচ্ছে। অথচ আইসিবি অন্যান্য সেক্টরে বিনিয়োগ করে প্রতি অর্থবছরেই রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা করছে। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতায় চাহিদা অনুযায়ী অর্থ বিনিয়োগ না করার কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা বলেন, আইসিবি সাধারণ বিনিয়োগকারীর মতো অতি মুনাফার আশা করে।

এ ব্যাপারে তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইসিবির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে তারা কি ধরনের ভূমিকা রাখছে, তা পোর্টফলিও বিশ্লেষণ না করে বলা সম্ভব নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতায় আইসিবির বড় ধরনের ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। তবে বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে আইসিবিও ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। বাজারের স্বার্থে আইসিবির বাজারে তাদের বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।