আবদুর রাজ্জাক, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ব্যাংক ব্যবস্থায় তারল্য সঙ্কটের প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। এতে গত আড়াই মাস ধরে চলা দরপতনের তীব্রতা আরো বাড়ছে। দেশের পুঁজিবাজারে দরপতন গড়িয়েছে টানা ১৫ কার্যদিবসে। টানা ১৫ কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ১৬ হাজার কোটি টাকা উধাও। নীরবে রক্তক্ষরণ চলছে পুঁজিবাজারে।

ফলে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে দেশের পুঁজিবাজার। এই সময়ে ডিএসই’র মূল্যসূচক কমেছে ২৮৩ পয়েন্ট, ৫ শতাংশেরও বেশি। হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকার পুঁজি। দেখার যেন কেউ নেই। সোমবার ডিএসই’র সূচক কমেছে ৬১ পয়েন্ট এবং বাজার মূলধন কমেছে ২ হাজার কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পুঁজিবাজারে আস্থা সংকটে এই পতন। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বলছে, পুঁজিবাজার স্থিতিশীল। টানা দরপতনে ডিএসইর মূল্যসূচকটি ফিরে গেছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের অবস্থানে। যদিও এর আগের প্রায় সবগুলো সংসদ নির্বাচনের পর পুঁজিবাজারে উর্ধ্বগতি প্রবনতা দেখা গেছে।

পর্যবেক্ষনে দেখা গেছে, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পরবর্তি তিন মাসে ডিএসইর মূল্যসূচক বেড়েছিল ৭৮ শতাংশ। ২০০১ সালের নির্বাচনের পরবর্তি তিন মাসে এ সূচকটি বাড়ে ২৬ শতাংশ। আর ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর এ সূচকটি প্রায় ৫ শথাংশ বেড়েছিল।

তবে এবারের নিবচনের পর প্রথম মাসের ১৮ কার্যদিবসে সূচকটি প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ বাড়লেও পরবর্তিতে তা কমে গিয়ে আগের অবস্থানে ফিরে আসে। মূলত দেশের পুরো আর্থিক খাতের তারল্য সঙ্কট ও সুদহার বৃদ্ধিই পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভঅব ফেলছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশের আর্থিক খাতের সঙ্কট পুঁজিবাজার গ্রাস করছে। তারা জানান, গত দেড় বছর ধরে ব্যাংক খাতে তরল্য সঙ্কট চলছে, যা বর্তমানে আরো তীব্র আকার ধারন করেছে। অর্থ সঙ্কটের কারণে ব্যাংকগুলো রপ্তানি বিল নগদায়নও বন্ধ রেখেছে। ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৬ শতাংশ।

বিপরীতে ঋণের প্রবৃদ্ধি প্রায় ১২ শতাংশ। আমানতের বিপরীতে ঋণ বেশি হওয়ায় তারল্য সঙ্কট তৈরী হয়েছে। এরমধ্যে আবার বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের মূল্য ধরে রাখতে বাজারে ডলার ছেড়ে টাকা উঠিয়ে নিচ্ছে। সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সরকারও অর্থ ধার করছে। আার খেলাপিদের বড় ধরনের সুযোগ দেওয়ায় সাধারণ ঋণ থেকেও ব্যাংকের কিস্তি আদায় কমে গেছে। সবমিলিয়ে পুরো আর্থিক খাতে তারল্য পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় রয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে। তারল্য সঙ্কটের কারণে সরকার ঘোষিত ব্যাংক সুদহার নির্ধারিত মাত্রায় ধরে রাখা যাচ্ছেনা। বর্তমানে ব্যাংকখাতে আমানতের সুদহার ১০ থেকে ১১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১২ শতাংশে আমানত নিচ্ছে। সুদহার বেড় যাওয়ায় পুঁজিবাজার থেকে ঝুকিপূর্ণ বিনিয়োগ প্রতাহার করে ব্যংকে আমানত রাখছেন অনেক বিনিয়োগকারী। ফলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের কারণে ক্রেতাসঙ্কট দেখা দিয়েছে।

এদিকে টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর উর্ধ্বগতির সময়ে যারা উচ্চমূল্যে শেয়ার ক্রয় করেছিলেন, তাদের প্রায় সবাই আটকে গেছেন। নতুন বছরে প্রায় ৬৩ শতাংশ শেয়ারের দর কমেছে। এসব শেয়ারের বিনিয়োগকারীরা নতুন করে লেনদেন সক্ষমতা হারিয়েছেন।

আবার বিদেশীরা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত নিট বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভঅব রাখলেও গত এক মাস ধরে তারাও শেয়ার কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। এসব কারণেই দরপতনের তীব্রতা বাড়ছে।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে ইবিএল সিকিউরিটিজের প্রধান পরিচালণ কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, টানা দরপতনের প্রধান কারণ হচ্ছে তারল্য সঙ্কট। দেশের আর্থিক খাতে দীর্ঘদিন ধরেই এ সঙ্কট চলছে। গত কয়েক মাস ধরে সুদের হারও বাড়ছে। আর সুদহার বাড়লে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকে আমানত রাখবেন, এটাই স্বাভাবিক।

আমাদের পুঁজিবাজারে এখন বিদেশী বিনিয়োগ কিছুটা শ্লথ যাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, তারা টাকার অবমূল্যায়নের অপেক্ষায় রয়েছেন। পাশ^বর্তী দেশগুলোতে কিন্তু মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়ে গেছে এবং সেসব দেশে এর প্রভঅবও পড়েছে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে রপ্তানিতে সহায়তার পাশাপাশি বিদেশীরাও বিনিয়োগে আসবেন। টানা মন্দার পর বিনিয়োগ অনুকুল পরিবেশ তৈরী হয় বলে জানান হুমায়ুন কবির। এ কারণেই সহসাই পুঁজিবাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

এ বিষয় জানতে চাইলে সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারের মূল সমস্যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট। এ সংকট দূর করতে হবে। ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, কারসাজির মাধ্যমে কেউ পুঁজি হাতিয়ে নিলে তার বিচার হবে, বিনিয়োগকারীদের এ নিশ্চয়তা দিতে হবে। অর্থাৎ পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ফলে বাজারে নতুন পুঁজি আসবে, যা তারল্য সংকট কাটাতে সহায়তা করবে।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৪ মার্চ ডিএসই’র বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা। ১৫ কার্যদিবসের ব্যবধানে সোমবার ৪ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এ সময়ে ডিএসই’র বাজার মূলধন ১৬ হাজার কোটি টাকা কমেছে।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার পুঁজিবাজার মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন বলেন, ২০১০-১১ সালের পর শেয়ারবাজারের উন্নয়নে নানা সংস্কার করা হয়েছে।

ফলে ৮ বছরে শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়নি। স্বাভাবিক উত্থানপতন হয়েছে। বাজার আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি স্থিতিশীল। তিনি বলেন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের মাধ্যমে শেয়ারবাজার এখন সমৃদ্ধ ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। যেখানে বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়েছে।

সূত্র বলছে, বাজারে এখন একধরনের আতঙ্ক রয়েছে। এটি হল বিও অ্যাকাউন্টে করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাধ্যতামূলক করার আতঙ্ক। সাম্প্রতিক এক অনুষ্ঠানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে বাজারে খবর ছড়ানো হয়েছে। তবে বিএসইসির চেয়ারম্যান বলছেন এটি গুজব। কারণ এ ধরনের সিদ্ধান্ত হলে বিএসইসিকে জানানো হতো।