দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বড় উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন; কিন্তু তাদের বেশির ভাগই ঋণ পরিশোধ করছেন না। নানা কৌশলে পার পেয়ে যাচ্ছেন। এতে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকিং খাত। বড় উদ্যোক্তারা ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে যাচ্ছে। ফলে খেলাপি ঋণ পরিচর্যা করতে ব্যাংকের আয় কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ছে মূলধন ঘাটতি। বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সামনে ব্যাংকিং খাতসহ গোটা অর্থনীতিকে কঠিন মূল্য দিতে হবে।

এমনি অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি। তিনি বলেন, বড় ঋণখেলাপিদের কারণেই ব্যাংক সম্পদের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। বাড়ছে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ। এতে ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। ফলে বাড়ছে ঝুঁকি। দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই বড় ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ঋণ আদায় এখন সময়ের দাবি।

কিন্তু তা না করে বিপরীত অবস্থান নিচ্ছেন নীতিনির্ধারকেরা। এখন বড় ঋণখেলাপিদের ছাড় দিতে নানা সুযোগসুবিধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের বিপরীতে দীর্ঘ ১২ বছরের জন্য তাদের ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। শুধু ঋণ নবায়ন নয়, ছাড় দেয়া হচ্ছে বিদ্যমান সুদহারেও।

দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানান, ব্যাংকগুলো এখন গড়ে আমানত নিচ্ছে ৯ শতাংশ মুনাফায়। এর সাথে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা, ভবন ভাড়া, নানা ইউটিলিটি বিলসহ নানা প্রশাসনিক ব্যয় কম করে হলেও ৩ শতাংশ যুক্ত করলে ১০০ টাকা আমানত নিতে ১২ টাকা ব্যয় হয়ে যায়।

এখন ১২ টাকা ব্যয় করে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হলে ব্যাংকের নিট আয় কমে যাবে। বড় ঋণগ্রহীতাদের ডাউন পেমেন্ট ও সুদহারে ছাড় দেয়া হলে সামগ্রিক ব্যয় গিয়ে পড়বে ভালো গ্রাহকদের ওপর। ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য নানা সার্ভিস চার্জ আরোপ করা ছাড়া বিকল্প থাকবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ব্যাংকিং খাতে এখন ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে হয়েছে ৯ লাখ ৭৬ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করার কথা ছিল ১ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ৬ সরকারি ব্যাংকসহ ১১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি। এই ব্যাংকগুলো বিরাট অঙ্কের মূলধন ঘাটতির মুখে পড়ে গেছে। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর এ মূলধন ঘাটতি হয়েছে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ডিসেম্বর শেষে সাড়ে ১২ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণের কথা থাকলেও ব্যাংকগুলো তা অর্জন করতে পারেনি। উল্টো এ সময়ে ১১ ব্যাংকে বিশাল মূলধন ঘাটতির কারণে ব্যাংকিং খাতে সামগ্রিক মূলধন সংরক্ষণের হার আলোচ্য সময়ে হয়েছে সাড়ে ১০ শতাংশ।

জানা গেছে, সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, বছরের পর বছর কোনো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি থাকতে পারবে না। আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক মেনে নেবে। ২ বছরের পর মূলধন ঘাটতি হলে ওই ব্যাংককে হয় মার্জার অর্থাৎ অন্য কোনো ব্যাংকের সাথে একীভূত হয়ে যেতে হবে, অথবা তা বন্ধ হয়ে যাবে।

এ কারণে কোনো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হলে, তা কিভাবে পূরণ করবে তার পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ে সময়ে তা মনিটরিং করবে। এভাবে দুই বছর পর আইন অনুযায়ী ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতিতে সামগ্রিক দুর্বলতাই ফুটে উঠে। এর ফলে শুধু ব্যাংকিং খাতে নয়, পুরো অর্থনীতিতেই বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা থাকে। বিদেশী বিনিয়োগেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদন্ডে উন্নীত করতে দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য রোডম্যাপ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। চার বছরব্যাপী রোডম্যাপ শেষ হতে চললেও ব্যাংকগুলো কাক্সিক্ষত হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। সূত্র জানিয়েছে, রোডম্যাপ অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে না পারার অন্যতম কারণ ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ।

আর খেলাপি ঋণ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর চেয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর বেশি। এ কারণে সরকারি ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি। ফলে মূলধন ঘাটতির মুখে পড়েছে সরকারি ব্যাংকগুলো। এর পুরো প্রভাব পড়েছে ব্যাংকিং খাতে।