দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার চাঙ্গা করতে বড় ব্যাংকগুলোকে ৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের সুযোগ দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আস্থা সঙ্কটে থাকা পুঁজিবাজারে নগদ টাকার প্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগ হিসেবে বিদ্যমান বিনিয়োগসীমা সংক্রান্ত আইন পরিবর্তন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই পরিবর্তন হয়েছে।

গত কয়েক বছর ধরেই পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সঙ্গে বাজার সংশ্লিষ্টরা নগদ টাকার প্রবাহ বাড়াতে বিনিয়োগসীমা সংক্রান্ত আইনটি পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছিল।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা সংক্রান্ত জটিলতা অবসানে বিএসইসির এ প্রস্তাবে সায় ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুরুতে এ বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহী ছিল না। তবে শেষ মুহূর্তে হলেও পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরাতে বিনিয়োগসীমা সংক্রান্ত আইন পরিবর্তনের পক্ষে মত দিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে এই ছাড়ের মাধ্যমে ব্যাংক নতুন করে পুঁজিবাজারে অর্থলগ্নি করবে। আর যেসব প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত বিনিয়োগ রয়েছে, তাদের শেয়ার বিক্রি করতে হবে না।

এদিকে নানা জল্পনা কবল্পনা অবসান ঘটিয়ে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের বিষয়ে নমনীয় হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শিথিল করা হয়েছে বিনিয়োগের শর্ত। এখন থেকে পুঁজিবাজারের বাইরে থাকা কোম্পানির (Non-listed) সাধারণ শেয়ার, সাধারণ শেয়ারে রূপান্তরযোগ্য নয় এমন প্রেফারেন্স শেয়ার, শেয়ারে রূপান্তরযোগ্য নয় এমন বন্ড, ডিবেঞ্চার ও বে-মেয়াদী মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগকে ব্যাংকের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসেবে হিসাবায়ন করা হবে না। বৃহস্পতিবার এই বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ব্যাংক কোম্পানি কর্তৃক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালা শিরোনামের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সরকারসহ বিভিন্ন অংশীজনের মতামত এবং পুঁজিবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তালিকাভুক্ত নয় এরূপ সিকিউরিটিজে (Equity Share, Non-convertible Cumulative Preference Share, Non-Convertible Bond, Debenture, Open-end Mutual Fund) ব্যাংকের বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে ব্যাংকের মোট বিনিয়োগ (Solo I Consolidated) হিসাবায়নে অন্তর্ভূক্ত না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারের জন্য খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংকগুলো এখনই বিনিয়োগ শুরু করবে এমন হয়তো নয়; কিন্তু বিনিয়োগ করার মতো সুযোগ তৈর হয়ে থাকছে তাদের জন্য।

এ বিষয়ে ডিএসইর এমডি কেএএম মাজেদুর রহমান বলেন, ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা থেকে তালিকাবহির্ভূত প্রতিষ্ঠান বাদ দেওয়ায় বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়বে। তারা বাড়তি কিছু অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ পাবে। এটা পুঁজিবাজার গতিশীল করতে ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক মোঃ রকিবুর রহমান বলেছেন, নতুন সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শিল্পায়ন, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার আরও বাড়ানোর জন্য একটি গতিশীল পুঁজিবাজার খুবই জরুরী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ইতিবাচক ভূমিকা শুধু পুঁজিবাজার নয়, দেশের অর্থনীতিকেই আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে। তিনি এই উদ্যোগের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, বিএসইসির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

ডিএসই ব্রোকারর্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি মোঃ শাকিল রিজভী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত খুবই চমৎকার ও ইতিবাচক। দীর্ঘ দিনের দাবি বাস্তবায়ন হলে। এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়বে। তারা চাইলে বাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে পারবে। বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) নির্বাহী কমিটির সদস্য ও এএফসি ক্যাপিটালের সিইও মাহবুব হোসেন মজুমদার বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তে ঘুরে দাঁড়াবে পুঁজিবাজার, কাটবে তারল্য সংকট। এটি আমাদের অনেক দিনের প্রত্যাশিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ইতিবাচক ভূমিকা দেশের পুঁজিবাজারের বিকাশে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন।

এ প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারে বহু সমস্যা রয়েছে। ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা থেকে তালিকাবহির্ভূত কোম্পানি বাদ দেয়া অবশ্যই পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক। তবে বাজার ভাল করতে হলে দুর্বল কোম্পানির তালিকাভুক্তি বাদ দিয়ে ভালমানের কোম্পানি নিয়ে আসতে হবে।

পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য ফোরামের সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত দাবি অবশেষে পূরন হলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ইতিবাচক ভূমিকা দেশের পুঁজিবাজারের বিকাশে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি।

জানা গেছে, ২০১০-১১ সালের পুঁজিবাজার বিপর্যয়ের পর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীলতায় ফেরাতে নেয়া কয়েকটি সুপারিশের মধ্যে একটি ছিল ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগকে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা হিসেবে হিসাব না করা। পরে ২০১৪ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের পর এসব বিষয় চাপা পড়ে যায়।

অবশ্য ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা পরিশোধিত মূলধনের ২৫ শতাংশ ঠিক রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়। তখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে বিরোধিতা করে আসছিলেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের যুক্তি ছিল, বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতার স্বার্থে কিছু বিনিয়োগকে এ সীমার বাইরে রাখতে পারে।

যেমন তালিকাবহির্ভূত কোম্পানি ও বিভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগ। এটা করা হলে ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য কিছু তহবিল বাড়তি পাবে। যেহেতু আমাদের পুঁজিবাজার এখনও পুরোপুরি পরিপক্ব নয়, তাই এখানে ব্যাংকই বাজারের মূলশক্তি। মিউচুয়াল ফান্ডগুলো এখনও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাই মিউচুয়াল ফান্ডসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি সক্ষমতা ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত পুঁজিবাজার সচল রাখতে গেলে বাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই।