দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ২০১৯-২০ অর্থ বছরের বাজেটে পোশাক শিল্পের জন্য নগদ প্রণোদনা এক শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে। পোশাক খাতে রফতানিকে উৎসাহিত করতেই প্রণোদনার পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এ তথ্য জানান।

বর্তমানে পোশাকখাতে প্রণোদনা শর্তানুযায়ী, দেশীয় উৎপাদিত কাপড় ব্যবহার করে উৎপাদিত পোশাক রফতানি করার পর দেশে যে আয় আসবে তার ওপর ৪ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয়। তবে বিদেশ থেকে কাপড় এনে পোশাক তৈরি করে রফতানি করলে কোনো প্রণোদনা পান না উদ্যোক্তারা। আবার নতুন বাজারের জন্য একইহারে প্রণোদনা দেওয়া হয়।

এর বাইরে ইউরোপের বাজারে দেশীয় কাপড় ব্যবহারের শর্তে পোশাক বানিয়ে রফতানি করলে ২ শতাংশ প্রণোদনা পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন বাজেটে শর্ত বহাল রেখে সবক্ষেত্রে এখন যা আছে তার চেয়ে ১ শতাংশ বাড়তি প্রণোদনা দেওয়া হবে।

বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি রুবানা হক বলেন, ‘আমাদের জন্য এটি একেবারেই সুসংবাদ নয়। আমরা ৫ শতাংশ আশা করি। পোশাক রফতানির সবক্ষেত্রে আমরা নগদ ৫ শতাংশ প্রণোদনা চাই। এটা না হলে আমরা মর্মাহত হবো। আর অন্য শিল্প থেকে কিন্তু তেমনভাবে রিটার্ন আসছে না। পোশাক শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। অন্তত আগামী দুই বছরের জন্য ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া দরকার।’

এ বিষয়ে সংগঠনটির সিনিয়র সহ-সভাপতি ফয়সাল সামাদ বলেন, ‘এই প্রণোদনা অনেক কম হয়ে যায়। রফতানি যদি বাড়াতে হয়, অন্যান্য দেশের সঙ্গে যদি প্রতিযোগিতা করতে হয় তাহলে কমপক্ষে ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিতে হবে।’

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘পোশাক রফতানিতে আমরা নগদ ৫ শতাংশ প্রণোদনা চেয়েছিলাম। আমাদের নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন করতে হয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। সে অর্থে ১ শতাংশ প্রণোদনা বৃদ্ধি খুব একটা হেল্পফুল হবে না। তাও যেহেতু ১ শতাংশ বাড়িয়েছে, তাই সরকারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আমরা আরও আলোচনা করব।’

পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা বলেছেন, এ খাতে বর্তমানে ক্রান্তিকাল চলছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য আরও বেশি নগদ প্রণোদনা দিতে হবে। একই সঙ্গে দ্রুত ও হয়রানিমুক্তভাবে যাতে নগদ প্রণোদনা পাওয়া যায়, সে বিষয়ে অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাক খাতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে আরও সুবিধা দিতে চায় সরকার।

জানা যায়, বর্তমানে পোশাক খাতে শর্তসাপেক্ষে নগদ প্রণোদনা সুবিধা দেওয়া হয়। শর্তানুযায়ী দেশীয় উৎপাদিত কাপড় ব্যবহার করে পোশাক বানিয়ে রফতানি করলে সেই আয় দেশে আসার পর, তার ওপর ৪ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয়। তবে বিদেশ থেকে কাপড় এনে পোশাক তৈরি করে রফতানি করলে সেক্ষেত্রে কোনো প্রণোদনা পান না উদ্যোক্তারা।

আবার নতুন বাজারের জন্য একই হারে প্রণোদনা দেওয়া হয়। এর বাইরে ইউরোপের বাজারে দেশীয় কাপড় ব্যবহারের শর্তে পোশাক বানিয়ে রফতানি করলে ২ শতাংশ প্রণোদনা পাওয়া যায়। সূত্র জানায়, নতুন বাজেটে শর্ত বহাল রেখে ‘সর্বক্ষেত্রে’ এখন যা আছে তার চেয়ে ‘বাড়তি’ আরও ১ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হবে।

রফতানি আয়ের ৭৮ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। গত অর্থবছরে মোট রফতানি আয় হয় তিন হাজার ৭০০ কোটি ডলার বা ৩৭ বিলিয়ন ডলার। দেশীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ তিন লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে পোশাক খাত থেকে এসেছে দুই হাজার ৯০০ কোটি ডলার বা দুই লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে রফতানি খাতে বছরে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেয় সরকার। এর ৮০ শতাংশই ভোগ করছে পোশাক খাত। এর বাইরে পাট ও পাটজাত পণ্যে প্রণোদনার জন্য পৃথক বরাদ্দ থাকে বাজেটে।

পোশাকে বাড়তি যে হারে প্রণোদনা দেওয়া হবে, তার জন্য আসন্ন বাজেটে আরও তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব থাকছে। জানা যায়, ক্যাশ ইনসেনটিভের পাশাপাশি নানা ধরনের কর প্রণোদনাও পাচ্ছে পোশাক খাত। বর্তমানে পোশাক খাতে উৎসে কর শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ। পোশাকের বিভিন্ন সেবায় ভ্যাট ছাড় ও অব্যাহতি রয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী, পোশাক পণ্য রফতানি করার পর আয় দেশে এলে তার ওপর প্রযোজ্য হারে প্রণোদনা দেওয়া হয়। অর্থাৎ ১০০ টাকার পোশাক রফতানি করলে প্রত্যাবাসিত সেই আয়ের ওপর নির্ধারিত হারে নগদ প্রণোদনা পান উদ্যোক্তারা।

কিন্তু পোশাক মালিকরা অভিযোগ করেন, প্রত্যাবাসিত আয়ের ওপর প্রণোদনা পান না তারা। বস্ত্র মূল্য অর্থাৎ সুতা, ডায়িং ও নিটিংয়ের দামের ওপর প্রণোদনা দেওয়া হয়। এর ফলে ৪ শতাংশের পরিবর্তে নিট প্রণোদনা পান আসলে ৩ দশমিক ২ শতাংশ। পোশাক মালিকরা মনে করেন, আইনে সরাসরি রফতানি বা প্রত্যাবাসিত আয়ের ওপর প্রণোদনা দেওয়ার বিধান আছে।

সেই নিয়ম অনুসরণ করে প্রণোদনা দিতে হবে। একই সঙ্গে প্রণোদনার ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারণ ও হার বাড়ানোর দাবি জানিয়ে কোনো রকম শর্ত ছাড়াই ঢালাওভাবে ৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি বাড়াতে ওই বাজারের জন্য নতুন করে সাড়ে ১৬ শতাংশ প্রণোদনার কথা বলেছেন পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা।

যোগাযোগ করা হলে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ইএবির সিনিয়র সহসভাপতি মো. হাতেম বলেন, বর্তমানে দেশীয় পোশাক খাতের বড় সমস্যা হচ্ছে পণ্যের ক্রমাগত দরপতন। এর ফলে অসম প্রতিযোগিতায় পড়েছে এই শিল্প। এ ছাড়া নতুন মজুরি কার্যকর হওয়ায় উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। এ অবস্থায় পোশাক খাতকে বাঁচাতে হলে নগদ প্রণোদনা আরও বাড়াতে হবে।

তিনি অভিযোগ করেন, প্রণোদনার টাকা পেতে বাংলাদেশ ব্যাংক, স্থানীয় রাজস্ব অডিট দপ্তর ও সিএ ফার্মসহ নানা জায়গায় পদে পদে চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন পোশাক মালিকরা। এ ছাড়া প্রণোদনা পেতে এক বছর সময় লাগে। দ্রুত ও হয়রানিমুক্তভাবে প্রণোদনা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

জানা যায়, শুল্ক্ক আরোপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বৈরী সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। চীনের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র সরকার অতিরিক্ত শুল্ক্ক আরোপ করায় চীন থেকে পোশাক পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা। এতে করে বাংলাদেশি পোশাক কেনার দিকে ঝুঁকছেন মার্কিন ক্রেতারা।

কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অতিরিক্ত শুল্ক্ক। এখন বাংলাদেশি পোশাক পণ্যকে সাড়ে ১৬ শতাংশ শুল্ক্ক দিয়ে মার্কিন বাজারে ঢুকতে হয়। অথচ বাংলাদেশের প্রতিযোগী অন্যান্য দেশ যেমন- ভিয়েতনাম ৫ শতাংশ, ভারত সাড়ে ৭ শতাংশ শুল্ক্ক দিয়ে পোশাক রফতানি করছে যুক্তরাষ্ট্রে।

এতে করে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে মো. হাতেম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আরও পোশাক পণ্য রফতানি করতে হলে প্রণোদনা দিতে হবে। এটা করলে আমাদের পোশাক রফতানি সে দেশে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ হবে।