দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: গতিহীন পুঁজিবাজার দিন দিন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। কোন উদ্যোগই সফল হতে পারছে না। অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার চাহিদা কমায় লেনদেন নেমে এসেছে ফের ৩০০ কোটি টাকার ঘরে। শেয়ারদরের ওঠানামাও সীমিত হয়ে পড়েছে। পুঁজিবাজারের প্রতি সকল পক্ষকে বেশ মনোযোগী হতে দেখা গেলেও বাজারের টালমাটাল অবস্থা থেকে বের হতে পারছে না। বাজারের গতিবিধি ঠিক কোনদিকে যাচ্ছে বিনিয়োগকারীরা বুঝে উঠতে পারছেন না।

সূচক বাড়ছে তো লেনদেন কমছে, আবার লেনদেন বাড়ছে তো সূচক কমছে। বিনিয়োগকারীরা অনাহুত বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন। বাজারের এরকম অস্থির আচরণে কিছুটা দু:চিন্তায়ও তারা। তবে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান বাজার নিয়ে দু:চিন্তার কোন কারণ নেই। তাঁদের মতে, পুঁজিবাজারকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। তাহলে বাজার স্বাভাবিকভাবে বাড়বে, সংশোধন হবে।

এদিকে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে দু:চিন্তায় পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। কারন পুরো পুঁজিবাজার একমুখী নীতিতে চলায় শতকরা ৭০ শতাংশ বিনিয়োগকারী লোকসানে রয়েছেন। আর বিদেশী বিনিয়োগকারীরসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের খপ্পরে পড়ে যাচ্ছে বাজার। ফলে পুঁজিবাজার অস্থিরতা বাড়ছে।

বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন বাজারে কোন এই অস্থিরতা, এই অস্থিরতার পেছনে দায়ী কে? এ বিষয় অনুসন্ধান করতে গিয়ে দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের গবেষনা সেলে চলে আসছে নানা তথ্য। তবে অজানা আতঙ্ক আর বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতায় তিন মাসের বেশি সময় ধরে মন্দাভাব বিরাজ করছে পুঁজিবাজারে। হঠাৎ করে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের আতঙ্ক আরও বেড়েছে।

বিশেষ করে গত দুই মাস (মার্চ ও এপ্রিল) দরপতনের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল বিদেশিদের শেয়ার বিক্রি। এ দুই মাসেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার থেকে যে পরিমাণ শেয়ার ক্রয় করেছেন বিক্রি করেছেন তার চেয়ে বেশি। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এমন অব্যাহত শেয়ার বিক্রির কারণে বাজারে আস্থাহীনতা যেমন বেড়েছে, তেমনি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ফলে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হলেও বিনিয়োগকারীদের আতঙ্ক কাটেনি।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগের পরিমাণ খুব বেশি নয়। কিন্তু সমস্যা হলে বিদেশিরা যখন শেয়ার বিক্রি করেন তখন একযোগে করেন। ফলে বাজারে এক ধরনের প্যানিক সৃষ্টি হয়। এছাড়া সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক সব ধরনের বিনিয়োগকারীর মধ্যে একপ্রকার ধারণা আছে যে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা খুবই দক্ষ।

ফলে তাদের শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ার পেছনে নেতিবাচক কিছু থাকতে পারে এমন ধারণার কারণেও খুব সহজে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তারা বলছেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। এ বাজারে সবধরনের বিনিয়োগকারীর ঝুঁকি নিতে হবে। তবে সেই ঝুঁকি হতে হবে জ্ঞাননির্ভর। আন্দাজের ওপর বা গুজবে ভর করে বিনিয়োগ করা ঠিক নয়। বাজারে ভালোভাবে বুঝে বিনিয়োগ না করলে লাভের বদলে লোকসান হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

বাজার-সংশ্নিষ্টরা জানান, সা¤প্রতিক দরপতনের প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাজার পরিস্থিতি উন্নতির স্বার্থে নানা পর্যায় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার তেমন কোনো প্রভাব বাজারে নেই। মধ্যে দু-একদিন শেয়ারদর, সূচক ও লেনদেন বাড়লেও তা স্থায়ী হয়নি। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি বিনিয়োগ করার সুযোগ করে দিতে আইনি সংস্কার আনা হয়েছে।

উপরন্তু তারল্য সংকট সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে ৮৫৬ কোটি টাকার স্বল্প সুদের ঋণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের প্রভাব বাজারে নেই। এ কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্ত।

কয়েকটি শীর্ষ মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তারা জানান, ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীদের সিংহভাগই নিষ্ফ্ক্রিয়। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ আগের মতোই নগণ্য পর্যায়ে। এ অবস্থায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্তহীনতায়। যার সার্বিক প্রতিফলন পড়ছে লেনদেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শীর্ষ এক মার্চেন্ট ব্যাংকার জানান, দুর্বল মৌলভিত্তির আইপিও এবং প্লেসমেন্ট ইস্যুতে বাজারের প্রধান স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে এক ধরনের শীতল যুদ্ধ চলছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আইনি সংস্কারের ঘোষণার পর জটিলতা আরও বেড়েছে।

এ বিষয় জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ বলেন, বাজার পরিস্থিতি একেবারে ঘোলাটে। নানা অনিয়ম বের হয়ে আসছে। আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে এ পুঁজিবাজার চললেও দেখা যাচ্ছে, কোম্পানিগুলোর দেওয়া আর্থিক প্রতিবেদন মিথ্যা তথ্যে ভরপুর।

আইপিওতে আসার সময়ই কোম্পানিগুলো মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে। বেশি দামে বিনা ঘোষণায় শেয়ার বিক্রি করে চলে যাচ্ছে মালিকপক্ষ। সবকিছু দেখে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরম আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে সূচক ও লেনদেনে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এপ্রিলজুড়ে বিদেশিরা ৬৬৮ কোটি ২৭ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন করেন। এর মধ্যে শেয়ার ক্রয়ের পরিমাণ ছিল ২৫৭ কোটি চার লাখ টাকা। বিপরীতে শেয়ার বিক্রির পরিমাণ ৪১১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ এপ্রিলে বিদেশিরা যে টাকার শেয়ার ক্রয় করেছেন বিক্রি করেছেন তার থেকে ১৫৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা বেশি।

এপ্রিলের মতো মার্চেও বিদেশিরা শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেন। মার্চজুড়ে বিদেশিদের শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৮৭৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে শেয়ার ক্রয়ের পরিমাণ ছিল ৩৭৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা। বিপরীতে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৯৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি হয় ১২৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

তথ্য পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে ২০১৮ সাল জুড়েই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার লেনদেনের ক্ষেত্রে একধরনের অস্থিতিশীল অবস্থা ছিল। বছরের বেশির ভাগ সময় বিদেশিরা শেয়ার বিক্রির চাপ অব্যাহত রাখে। ফলে সার্বিক বাজারে দেখা দেয় নেতিবাচক প্রভাব।

বছরটিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ায় এপ্রিলে। এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত টানা পাঁচ মাস বিদেশিরা শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেন। তবে সেপ্টেম্বরে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রির চেয়ে ক্রয় বেশি করে। কিন্তু নির্বাচনের ডামাডোলের কারণে অক্টোবরে আবার পাল্টে যায় সেই দৃশ্য। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা তিন মাস শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করে বিদেশিরা। ফলে সার্বিক বাজারে পড়ে নেতিবাচক প্রভাব।

এ পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় একদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ভোটের পর বিদেশিদের শেয়ার ক্রয়ের চাপ বাড়ে। ফলে জানুয়ারি মাসজুড়েই বড় ধরনের উত্থান হয় বাজারে। পরের মাস ফেব্রুয়ারীতেও বিদেশিদের শেয়ার ক্রয়ের পরিমাণ বেশি ছিল। এরপরও সার্বিক বাজারে এক ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দেয়। এ পরিস্থিতিতে মার্চ ও এপ্রিলজুড়ে শেয়ার বিক্রির চাপ অব্যাহত রাখে বিদেশিরা। ফলে বাজারে একধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

এ বিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, স¤প্রতি পুঁজিবাজারে যে দুরবস্থা দেখা দিয়েছে এর পেছনে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অব্যাহত শেয়ার বিক্রির চাপের কারণে বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ফলে একদিকে কমেছে মূল্য সূচক, অন্যদিকে লেনদেনের পরিমাণ তলানিতে ঠেকেছে।

তিনি বলেন, বাজারে বিদেশি বিনিয়োগ আসে হাতেগোনা কয়েটি হাউজের মাধ্যমে। বিদেশিরা যখন বিনিয়োগ করে তখন বাজারে তারল্য বৃদ্ধি পায় এবং শেয়ারের দাম বাড়ে। এতে লেনদেনও বেশি হয়। আবার তারা যখন শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ উঠিয়ে নেয়, তখন বাজারে তারল্য হ্রাস পায়। তারল্য হ্রাস পাওয়ায় শেয়ারের চাহিদা কমে, দাম কমে এবং লেনদেন হ্রাস পায়।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান বলন, অনেক প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারী আছেন যারা বিদেশিদের লেনদেন ফলো করেন। বিদেশিরা যখন বিক্রির চাপ বাড়ান, তখন এসব বিনিয়োগকারীও শেয়ার বিক্রি করে বেরিয়ে যান।

ফলে বিক্রির চাপ বেড়ে বাজার নিন্মমুখী হয়ে পড়ে এবং একধরনের তারল্য সঙ্কট দেখা দেয়। এর মূল কারণ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশই ডে-ট্রেডিং করে। প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীদের এমন আচরণ বন্ধ করে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করা উচিত।

ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, বিদেশিদের ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর বাজার ওঠা-নামা করে, এটা বাজারের অত্যন্ত দুর্বল দিক। এর মূল কারণ হলো আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, মিউচ্যুয়াল ফান্ড কারও কোনো ভূমিকা নেই। বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ সামাল দেয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী আমাদের মার্কেটে নেই। যখন বিদেশিরা শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ায় তখন ক্রেতা থাকে না এবং বাজারে পতন হয়।