দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নৌকায় চড়ে দু’জনই এমপি হয়েছেন। বিগত দশম জাতীয় সংসদে এমপি হওয়ার পর দু’জনই ছিলেন প্রভাবশালী মন্ত্রী। তাদের হুমকি-ধমকি ও দাপটে অনেককে থাকতে হতো আতঙ্কে। মন্ত্রিত্বের সময় তাদের হুঙ্কার, কথাবার্তা ও কর্মকান্ডে সরকারকে বার বার বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। প্রভাবশালী ওই দুই নেতা নৌকার এমপি হয়েও এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরুদ্ধে মিশন নিয়ে মাঠে।

যদিও একজন জাসদ আরেকজন সাবেক জাসদ নেতা এখন দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বহীন। এমপি আছেন; কিন্তু মন্ত্রিত্ব না পাওয়ায় সেই দাপট আর নেই। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে তাদের অবস্থান বর্তমানে ‘নৌকার’ বিরুদ্ধেই। স্থানীয় নির্বাচনে (উপজেলা) নৌকার বিরুদ্ধে জেহাদ করেছেন। তাদের একজন হলেন সাবেক নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, অপরজন সাবেক তথ্যমন্ত্রী জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু।

গত ১৮ জুন মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাচনে শাজাহান খান আওয়ামী লীগ (নৌকা) প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেন। এতে জেলার অপর এমপি আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের সঙ্গে বিরোধ বাধে।

আর নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধে জাসদ ভেঙে দুই টুকরো হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জামায়াতের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়ে মিডিয়া গরম করা হাসানুল হক ইনু এখন কুষ্টিয়ায় জামায়াতের শেল্টারেই রাজনীতি করছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া ইনু জামায়াতের শেল্টার ছাড়া কুষ্টিয়ায় যেতে পারেন না এটা এখন ওপেন সিক্রেট।

সত্তরের দশকে জাসদের রাজনীতি দিয়েই শাজাহান খানের উত্থান। পরিবহন শ্রমিক নেতা হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। মাদারীপুর-২ (সদরের একাংশ ও রাজৈর) আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য শাজাহান খান উপজেলা নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে ছিলেন। এ জন্যই মাদারীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের সঙ্গে তার বিরোধ চলছে। মাদারীপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কাজল কৃষ্ণ দে-কে নৌকার প্রার্থী করেন।

দলের স্থানীয় নেতারা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নামেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে শাজাহান খান প্রার্থী করেন ওবায়দুর রহমান কালু খানকে। নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীকে পরাজিত করে আনারস প্রার্থী (কালু) উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে শাজাহান খান অবস্থান নেয়ায় বর্তমানে দলীয় নেতাকর্মীরা তার ওপর ক্ষুব্ধ।

দেশের রাজনীতিতে শাজাহান খান আলোচিত নাম। নৌকা প্রতীকে এমপি হলেও নৌ-মন্ত্রী থাকার সময় তার ভয়ঙ্কর দাপটে মানুষ থাকত আতঙ্কে। মন্ত্রিত্বের প্রভাব খাটিয়ে তিনি জুলুম-নির্যাতন করতেন। এমনকি টিভির লাইভ টকশোতে তিনি সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার চোখ তুলে নেয়ার ঘোষণা দেন। এতে সরকারকে পড়তে হয় বিব্রত অবস্থায়। মন্ত্রী হয়েও তিনি নৌ-শ্রমিক, গার্মেন্টস শ্রমিক এবং পরিবহন শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেন।

সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানিতে সরকার যখন বিব্রত তখন তিনি ঘোষণা দেন ‘রাস্তার ছাগল-ভেড়া চিনলেই ড্রাইভারদের লাইন্সেস দিতে হবে’। বিভিন্ন সময় পরিবহন ও নৌ পরিবহন ধর্মঘটের সময় তিনি পরিবেশ শান্ত করার পরিবর্তে শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে সহায়তা করেন। কখনো ‘সর্প হইয়া দংশন/ওঝা হয়ে ঝাড়া’ প্রবাদের মতো শ্রমিকদের উস্কে দেন; আবার মন্ত্রী হিসেবে বিরোধ মিটানোর চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধু যখন সকলকে নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ছুটে বেড়ান; তখন সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদের ঘোষণা দিয়ে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গঠিত হয় জাসদ।

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে জাসদ দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। রাজনীতির রহস্যপুরুষ সিরাজুল আলম খান তার বইয়ে ছিখেছেন ওই সময় বঙ্গবন্ধুর সরকারকে নাস্তানাবুদ করতে ‘শাহাজান খান থানা লুট করেছিলেন’। শুধু তাই নয়, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের দলীয় নমিনেশন পাচ্ছেন না বুঝে তিনি তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করে বিএনপিতে যোগদানের চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে বাধ্য হয়েই তাকে নৌকার প্রার্থী করা হয়।

সেই জাসদের নেতা শাজাহান খান নৌ পরিবহন মন্ত্রী থাকাবস্থায় পরিবহন শ্রমিক আন্দোলন, গ্রার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন, নৌ পরিবহন শ্রমিক আন্দোলনসহ আন্দোলনে ঘি ঢেলেছেন। কোটা বাতিলের দাবিতে ছাত্র-ছাত্রীদের কর্মসূচিতেও ঘি ঢালেন। খালেদা জিয়ার অফিসের সামনে শ্রমিকদের দিয়ে অবস্থান নিয়ে তিনি দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় খবরের শিরোনাম হন।

দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া এবং শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের শাস্তি দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, সা¤প্রতিক বিভিন্ন নির্বাচনে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিষয়ে দলের সভাপতির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। যারা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আভাস দিয়েছেন তিনি। দলের কার্যনির্বাহী সংসদের পরবর্তী বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকা, বঙ্গবন্ধুর ছবি, নৌকা প্রতীকে অসম্মান করেছিল এই শাজাহান খান। তিনি মন্ত্রী হয়ে কোনো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পাশে থাকেননি। থেকেছেন তার গণবাহিনী ও জাসদের নেতাকর্মীদের নিয়েই। সব সময় নৌকায় চড়ে সুবিধা নিয়ে এখন নৌকার বিরোধিতায় নেমেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত মাসে আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যারা নৌকা নিয়ে এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন তারা যদি নৌকার বিরোধিতা করেন তারা আর জীবনেও কোনোদিন নৌকা মার্কা পাবে না।

অন্যদিকে দুর্দান্ত প্রতাপশালী সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর জাসদ দুই টুকরো হয়ে গেছে। মন্ত্রী থাকা না থাকা নিয়ে বিরোধে দল ভাঙলেও তিনি শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিত্ব ধরে রাখতে পারেননি। এই ক্ষোভে মাঝে মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় মানববন্ধন করেন। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনার পর ট্যাঙ্কে উঠে নৃত্য করা হাসানুল হক ইনু মন্ত্রিত্ব না পাওয়ায় এখন সরকারের কঠোর সমালোচক।

যদিও ইনুর ওই সময়ের কর্মকান্ডের চিত্র সিরাজুল আলম খান তার লেখা বইয়ে তুলে ধরেছেন। মন্ত্রী থাকার সময় ইনুর দাপট, চোটপাটে মানুষ অতিষ্ঠ থাকলেও রাজনীতিতে এখন তিনি চুপসে গেছেন। বিশেষ করে বেগম জিয়াকে দেশছাড়া করা এবং জামায়াত-শিবিরকে নিশ্চি‎হ্ন করার হুঙ্কার আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে মিডিয়ার কভারেজ নিয়েছেন।

তার মন্ত্রিত্বের দাম্ভিকতা আর ক্ষমতার ব্যবহারে বিএনপির নেতাকর্মীরা থাকতেন আতঙ্কিত। জামায়াত-বিরোধী ইমেজ গড়ে নৌকায় চড়ে এমপি হয়েছেন অথচ নির্বাচনী এলাকা কুষ্টিয়ার স্থানীয় রাজনীতিতে তিনি আওয়ামী লীগের ঘোর বিরোধী হিসেবে পরিচিত। মাঠে ময়দানে মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান এবং জামায়াত-বিরোধী কথাবার্তা বললেও কুষ্টিয়ার স্থানীয় রাজনীতিতে তিনি জামায়াতের শেল্টারেই আসা-যাওয়া করেন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি মোকাবিলা করার জন্য এখন ‘জামায়াতি লাঠি’ হিসেবে ব্যবহার করেন।

কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও জাসদের স্থানীয় নেতারা জানান, হাসানুল হক ইনুর রাজনীতিতে জামায়াত বিরোধিতা কার্যত লোক দেখানো। তিনি পর্দার আড়ালে জামায়াতের শক্তির ওপর নির্ভরশীল নেতা। কুষ্টিয়ার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে সাইজ করতে জামায়াতকে ব্যবহার করে থাকেন। কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলার ১৩ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এবং ভেড়ামারা উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত কুষ্টিয়া-২ আসনের এমপি হাসানুল হক ইনু।

বিগত দিনে মিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন জামায়াত নেতা আবদুল গফুর ও ভেড়ামারা উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। ভেড়ামারা উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন ২০ দলীয় জোট নেতা আহসান হাবিব লিংকন অনুসারী। কিন্তু মিরপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল গফুর হলেন স্থানীয় রাজনীতিতে হাসানুল হক ইনুর ডানহাত। স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতি মোকাবিলা করতে তিনি আবদুল গফুরের নেতৃত্বাধীন জামায়াতকে ব্যবহার করে থাকেন।

শুধু তাই নয়, গত ১০ বছরে মন্ত্রী এবং এমপি হিসেবে ইনু স্থানীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চেয়ে বেশি সুবিধা দিয়েছেন জামায়াতের নেতাকর্মীদের। গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ নেতারা ঘোষণা দেন তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা আবদুল গফুরকে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে দেয়া হবে না। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সেই ঘোষণাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জামায়াত নেতা গফুরকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।

নৌকায় চড়ে এমপি হয়ে শাজাহান খান ও হাসানুল হক ইনুর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া রহস্যজনক। তবে মন্ত্রিত্বের দাপট এখন আর নেই। এখনো দুই নেতা জাতীয় সংসদের এমপি, নিজ এলাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করছেন; কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে অনেকটা এতিমের মতোই হয়ে গেছেন। কোথায় গেল তাদের সেই দাপট! সুত্র: ইনকিলাব