বিশেষ প্রতিনিধি, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: চলতি অর্থবছর শেষে সরকারের পুঞ্জীভূত ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণ প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের গ্যারান্টি ৪২ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ ঋণের গ্যারান্টি ১৫ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে এর পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ৭১ হাজার কোটি টাকা।

এক বছরের ব্যবধানে সরকারের পুঞ্জীভূত ব্যাংক গ্যারান্টি কমেছে ১৩ হাজার ৬৭৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। মূলত বিদ্যুৎ খাতে পুঞ্জিভূত ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় সার্বিকভাবে সরকারের ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণ কমেছে।

আগামী অর্থবছরের বাজেট উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রদত্ত ব্যাংক গ্যারান্টির মধ্যে বিভিন্ন বিদেশী ব্যাংক ও চীনা প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে ৪২ হাজার ২৬৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৫৬ হাজার ৭৫ কোটি টাকা।

রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থার গৃহীত ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে (সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বিকেবি ও রাকাব) অবশিষ্ট ১৫ হাজার ৫৫৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা।

এখানে বলা রাখা ভালো যে, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও বিদ্যুৎ খাতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, সার আমদানি, বাংলাদেশ বিমানের জন্য বোয়িং ক্রয়, জ্বালানি তেল আমদানি ও কৃষি ঋণ বিতরণসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংস্থা দেশী-বিদেশী এসব ঋণ নিয়েছে, যার গ্যারান্টার হচ্ছে সরকার।

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে সরকারের নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের স্বার্থে সরকারি মালিকানাধীন আর্থিক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গৃহীত ঋণের জন্য গ্যারান্টি ও কাউন্টার গ্যারান্টি প্রদান করে থাকে সরকার।

কোনো কারণে ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ঋণ যথা সময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হলে এগুলো পরিশোধের দায়-দায়িত্ব তখন সরকারের ওপর বর্তায়। সুতরাং, সরকারের আর্থিক অবস্থার ওপর এসব ঋণের প্রভাব রয়েছে। গ্যারান্টির পরিমাণ বেড়ে গেলে সরকারের আর্থিক ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

খাতওয়ারি হিসাবে সরকারের ব্যাংক গ্যারান্টির শীর্ষে রয়েছে বিদ্যুৎ খাত। গত ২০০০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ খাতের ১৮টি প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে প্রদত্ত মোট গ্যারান্টির পরিমাণ হচ্ছে ৩৩ হাজার ৭৭৭ কোটি ২১ লাখ টাকা।

গত ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে বিদ্যুৎ খাতে বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে সরকারের ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে সরকারের ব্যাংক গ্যারান্টি কমেছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।

অন্যান্যের মধ্যে সার আমদানি খাতে ৫ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা, বাংলাদেশ বিমানের জন্য বোয়িং ক্রয়ে বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে ৪ হাজার ৯৩৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা, জ্বালানি তেল আমদানিতে ‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন’ (বিপিসি)-এর অনুক‚লে ৩ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা ও কৃষি ঋণের বিপরীতে ৩ হাজার ১৪৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়েছে সরকার।

অন্যান্যের মধ্যে বিজেএমসির অনুক‚লে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে ১ হাজার ১৩৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা এবং কোস্টাল শিপ ও ফেরি-সি-ট্রাক ক্রয়ে বিআইডব্লিউটিসির অনুক‚লে ৭০০ কোটি টাকাসহ বিবিধ খাতে মোট ২ হাজার ৯০৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে।

বৈদেশিক ঋণের গ্যারান্টির মধ্যে সিংহভাগই হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতের। বিদ্যুৎ খাতে এককভাবে সবচেয়ে বেশি গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে ‘এক্সিম ব্যাংক অব চায়না’-কে। এ ব্যাংককে প্রদত্ত গ্যারান্টির পরিমাণ হচ্ছে ৯ হাজার ৫৭৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ‘হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন (এইচএসবিসি ব্যাংক)।

তিনটি প্রকল্পের আওতায় গৃহীত ঋণের বিপরীতে এ ব্যাংককে গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে চার হাজার ৬৮৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা। অন্যান্যের মধ্যে ‘এক্সিম ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’-কে ৩ হাজার ৯০২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ‘এইচএসবিসি করপোরেট ট্রাস্টি কোম্পানি’-কে ২ হাজার ৪৫৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। দু’টি প্রকল্পের বিপরীতে ‘স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক’-কে ২ হাজার ৫৫৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ‘

জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন’-কে ১ হাজার ৫৯৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না’ (আইসিবিসি)-কে ১ হাজার ১১২ কোটি টাকা এবং দু’টি চীনা কোম্পানিকে চারটি প্রকল্পের বিপরীতে ২ হাজার ৮২৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা ও ভারতের ‘টাটা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড’-কে ৬২ কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং কেনার জন্য গত ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছয়টি ঋণ প্রস্তাবের বিপরীতে ৪ হাজার ৩৮২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে।

এর মধ্যে দুটি ঋণ প্রস্তাবের বিপরীতে ‘ইউএস এক্সিম ব্যাংক’কে ২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা ও চারটি ঋণ প্রস্তাবের বিপরীতে ‘এইচএসবিসি’কে ২ হাজার ১০৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে। এর বাইরে এ খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ‘সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেড’কে ৫৫৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে।

জেলাপর্যায়ে ডিজিটাল টেলিফোন স্থাপনে একটি চীনা কোম্পানিকে ১ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা এবং মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি প্রকল্পের উন্নয়নে একটি কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়েছে সরকার।