দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বোনাস লভ্যাংশ ও রিজার্ভে কর আরোপ সংক্রান্ত সংশোধিত প্রস্তাবে পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা স্বাগত জানিয়েছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুসারে, কোনো কোম্পানি নগদ লভ্যাংশের সমপরিমাণ বোনাস দিলে বোনাসের উপর কর দিতে হবে না। আর শুধু বোনাস দিলে অথবা নগদ লভ্যাংশের চেয়ে বেশি বোনাস দিলে ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।

অন্যদিকে নিট মুনাফার ৭০ শতাংশের বেশি রিটেইন্ড আর্নিংস ও রিজার্ভ হিসেবে স্থানান্তর করা না হলে তার জন্য কোনো কর দিতে হবে না।কিন্তু ৭০ শতাংশের বেশি স্থানান্তর করা হলে ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।

তবে প্রস্তাবিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে তালিকাভুক্ত কোম্পানির অর্জিত মুনাফা থেকে নগদ লভ্যাংশের পরিবর্তে বোনাস শেয়ার দিলে তাতে ১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। একইসঙ্গে কোম্পানির রিটেইনড আর্নিংস বা বিভিন্ন ধরনের রিজার্ভ পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি থাকলে বর্ধিত অংশের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হয়েছে। এই কর আরোপ নিয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের মধ্যে ভিন্নমত দেখা দিয়েছে।

সূত্র জানায়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের দুই ধরনের লভ্যাংশ দিয়ে থাকে। একটি হল স্টক ডিভিডেন্ড বা বোনাস শেয়ার। অন্যটি হলো নগদ লভ্যাংশ বা ক্যাশ ডিভিডেন্ড । সাধারণত বিনিয়োগকারীরা বোনাস শেয়ারের পরিবর্তে নগদ লভ্যাংশ প্রত্যাশা করেন। কিন্তু কোম্পানিগুলোর ছলছাতুরি করে নগদ লভ্যাংশের পরিবর্তে বোনাস শেয়ার দেয়ার প্রবণতা বেশি। এতে বিনিয়োগকারীরা তাদের প্রত্যাশিত প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন।

প্রস্তাবিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে স্টক ডিভিডেন্ড এর পরিবর্তে ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেওয়াকে উৎসাহিত করতে স্টক ডিভিডেন্ডের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। তবে পুঁজিবাজারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত স্টেকহোল্ডারদের বেশিরভাগ সংশোধিত প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন।

তবে অর্থনীতিবিদসহ কোনো কোনো স্টেকহোল্ডারের মতে, লভ্যাংশ ও বোনাসে কর আরোপের প্রস্তাব কার্যকর হলে বেসরকারি বিনিয়োগ, বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হতে পারে। তাদের মতে, কোম্পানি ব্যবস্থাপনার ব্যাষ্টিক পর্যায়ে রাষ্ট্রের এমন নিয়ন্ত্রণ না থাকা-ই ভালো।

উল্লেখ, গত ১৩ জানুয়ারি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল বোনাস লভ্যাংশ এবং নির্দিষ্ট সীমার অতিরিক্ত রিজার্ভের উপর ১৫ শতাংশ কর আরোপ করার প্রস্তাব করেন। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে এই প্রস্তাব দুটির কিছু সংশোধনের প্রস্তাব করেন।

অর্থমন্ত্রী ঘোষিত বাজেটে বোনাস লভ্যাংশের উপর ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করেছিলেন। পাশাপাশি তালিকাভুক্ত কোম্পানির রিটেইন্ড আর্নিংস ও রিজার্ভের সমষ্টি মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি হলে বাড়তি অঙ্কের উপর ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মো: রকিবুর রহমান বলেন, বোনাস ও রিজার্ভে করের সংশোধনী প্রস্তাবটি যুগান্তকারী। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা আবার বাজারমুখী হবেন। এতদিন যেসব অসাধু কোম্পানি বিনিয়োগকারীদেরকে বোনাসের নামে শুধু কাগজ ধরিয়ে দিত, সেগুলো এখন একটু চাপে পড়বে। তারা বিনিয়োগকারীদেরকে নগদ লভ্যাংশ দিতে বাধ্য হবে। কিন্তু ভালো কোম্পানিগুলোর উপর এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

তিনি বলেন, রিজার্ভে করের নতুন প্রস্তাবের ফলে কোম্পানিগুলো বেশি করে লভ্যাংশ দিতে বাধ্য হবে। এতদিন অনেক কোম্পানি অকারণেই মুনাফার বড় অংশ রিজার্ভে সরিয়ে নিত। অনেক কোম্পানিতে শত শত কোটি টাকা রিজার্ভ আছে, কিন্তু তারা ব্যবসা স¤প্রসারণে যায়নি। তাহলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বঞ্চিত করে এমন রিজার্ভ বাড়িয়ে কি লাভ? নতুন প্রস্তাব কার্যকর হলে পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাজার গতিশীল হবে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বোনাস লভ্যাংশ ও রিজার্ভের উপর কর আরোপের প্রস্তাবকে একটি ভুল প্রস্তাব মনে করেন। তার মতে, এই প্রস্তাব কার্যকর হলে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তিনি মনে করেন, কোম্পানি ব্যবস্থাপনার ব্যাষ্টিক পর্যায়ে রাষ্ট্রের এমন নিয়ন্ত্রণ না থাকা-ই ভালো। কোম্পানি পরিচালনায় যদি উদ্যোক্তাদের স্বাধীনতা না থেকে, চারদিক থেকে আটসাট পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় তাহলে তারা নতুন বিনিয়োগে উৎসাহ হারাবেন। এমনকি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তিতেও তাদের আগ্রহ কমে যাবে।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) এর সভাপতি মোঃ শাকিল রিজভী সংশোধিত প্রস্তাবকে ইতিবাচক ও বিনিয়োগকারীবান্ধব হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, বোনাস ও রিজার্ভে করের নতুন হার কার্যকর হলে হলে কোম্পানিগুলোর মধ্যে নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার প্রবণতা বাড়বে। এতে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবেন। সব মিলিয়ে পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ ভাল কোম্পানির মধে নগদ দিয়ে থাকে। বহুজাতিক কােম্পানিগুলো বোনাস লভ্যাংশ দেয় না বললেই চলে। গত ৬/৭ বছরে যে সব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে, যেগুলোর মৌলভিত্তি তুলনামুলক দুর্বল, সেগুলোর মধে বোনাস দেওয়ার প্রবণতা বেশি। ডিবিএ সভাপতি বলেন, কোম্পানির প্রবৃদ্ধি নেই, ব্যবসার জন্য দরকার নেই, তবু বোনাস দেওয়া হয়েছে মালিকদের শেয়ার বেচার সুবিধার্থে। এখন এই প্রবণতা একটু কমবে আশা করা যায়।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মোঃ ছায়েদুর রহমানের দৃষ্টিতে বোনাস লভ্যাংশ ও রিজার্ভের উপর করের সংশোধিত হার মন্দের ভালো। আগের প্রস্তাবের চেয়ে এটি কিছুটা ভালো। তিনি বলেন, নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার শর্তসাপেক্ষে বোনাসে কর অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগের কারণে কোম্পানিগুলো বোনাসের পাশাপাশি নগদ লভ্যাংশও দেবে। যারা স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে বিনিয়োগ করেন তাদের জন্য লাভবান হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।

কিন্তু বোনাস নিরুৎসাহিত করার কারণে কিছু দুর্বল কোম্পানির অসাধু কর্মকাÐে লাগাম পড়ার পাশাপাশি সত্যিকার অর্থে ভালো কোম্পানি, যাদের প্রবৃদ্ধি হার ভালো, ব্যবসা স¤প্রসারণের অনেক সুযোগ আছে, সেগুলোও কিন্তু কিছুটা চাপে পড়বে। তাদের ব্যবসা স¤প্রসারণের ব্যয় বেড়ে গেলে মুনাফার হার কমে যাবে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন চৌধুরী বোনাস ও রিজার্ভের নতুন করবিন্যাসকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, করের নতুন বিন্যাস বিনিয়োগকারী ও পুঁজিবাজার-উভয়ের জন্য কল্যাণকর হবে। কোম্পানিগুলো নগদ লভ্যাংশ দিতে উৎসাহিত হবে। এর মধ্য দিয়ে কোম্পানিগুলোর প্রকৃত আর্থিক শক্তি বুঝা যাবে। বিনিয়োগকারীরা যে নগদ লভ্যাংশ পাবেন, তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বাজারে পুনর্বিনিয়োগ হবে।

ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম সিএফএ বলেন, বোনাস লভ্যাংশ এবং রিটেইন্ড আর্নিংস ও রিজার্ভের করহার সংশোধনের বিষয়টি মোটামুটি ইতিবাচক। রিটেইনড আর্নিংস ও রিজার্ভের মোট স্থিতির পরিবর্তে প্রতি বছরের রিটেইনড আর্নিস এর উপর কর আরোপের বিষয়টি একটু স্বস্তি দেবে সবাইকে।