দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: খেলাপি ঋণের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। নাজুক অবস্থায় চলে এসেছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের ন্যাশনাল ফাইন্যান্সসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ যেমন অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে, সেই সাথে বেড়েছে আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণের পরিমাণ।

এতে আয়ের একটি বড় অংশই চলে যাচ্ছে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে। আবার কাঙ্খিত আমানত পাওয়া না গেলেও ঋণ বাড়ানো হয়েছে অধিক হারে। এক বছরের ব্যবধানে সাড়ে ১১ শতাংশ আমানত কমলেও বিপরীতে ঋণ বাড়ানো হয়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ হারে। অথচ আমানতের বিপরীতে ঋণের হার কম হওয়ার কথা ছিল। অপর দিকে বেড়েছে পরিচালন ব্যয়। ফলে সামগ্রিক আয় কমে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বেশির ভাগ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ প্রথমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রদর্শন করে বাস্তবে তার চেয়ে ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। প্রতিষ্ঠানগুলোর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরিদর্শন করা হলে অনেক প্রতিষ্ঠানই যথাযথভাবে খেলাপি ঋণ প্রদর্শন না করার প্রমাণ পাওয়া যায়। আবার যথাযথভাবে প্রভিশন সংরক্ষণ না করে আয় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর দেয়া তথ্য বাস্তবে পাল্টে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত মার্চ শেষে ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১২৬ কোটি টাকা, যা মোট ৭৯৬ কোটি টাকা ঋণের প্রায় ১৬ শতাংশ। অথচ তিন মাস আগেও অর্থাৎ ডিসেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ ছিল ১০৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৩ শতাংশ। এ হিসেবে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ।

এদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে আমানতকারীদের আমানত সুরক্ষার ক্ষেত্রে প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়। আর এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় খাত থেকে অর্থ দিয়ে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে বেশি হারে মুনাফা রাখতে হয়। আর বর্ধিত হারে মুনাফা সংরক্ষণ করতে গিয়ে ব্যাংকের মুনাফা কমে যায়। অপর দিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল আটকে যায়। এতে কমে যায় বিনিয়োগযোগ্য তহবিল।

ন্যাশনাল ফিন্যান্সের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় বর্ধিত হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে কমে গেছে আয়। যেমন গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়েছিল ৩৮ কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে মার্চে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪২ কোটি টাকা। একই সাথে কমেছে গ্রাহকদের কাছ থেকে সঞ্চয় বা আমানত সংগ্রহের পরিমাণ। ২০১৭ সালে ডিসেম্বর শেষে আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৮৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকার ওপরে। ২০১৮ সাল শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৪৩০ কোটি ৩৪ লাখ টাকায়।

এক বছরের ব্যবধানে আমানত কমেছে ৫৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির আমানত কমেছে ১১ দশমিক ৬২ শতাংশ। অপর দিকে এই সময়ে বিনিয়োগ ও ধার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি মেয়াদি ঋণ দিয়েছে ৪৮৫ কোটি টাকার। ২০১৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫১ কোটি ৪১ লাখ টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে মেয়াদি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রায় ১৪ শতাংশ। সঞ্চয় ৫৬ কোটি টাকার কমলেও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছে ৬৬ কোটি টাকার ওপরে হওয়ায় তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সাধারণত আমানতের চেয়ে ঋণ বিতরণ কম করতে হয়। কিন্তু ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রে হয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত, যা প্রতিষ্ঠানটির সামনে সঙ্কট বাড়িয়ে দেবে। এদিকে বর্ধিত এই বিনিয়োগ করতে প্রতিষ্ঠানটি ধার বাড়িয়েছে। ২০১৭ সাল শেষে প্রতিষ্ঠানটি অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও এজেন্টের কাছ থেকে ঋণ করেছিল ১৪৭ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। ২০১৮ সাল শেষে তা দাঁড়িয়েছে ১৬২ কোটি ৩০ লাখ টাকার বেশি।

এক বছরের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির ধার বৃদ্ধি পেয়েছে ১৫ কোটি ২৫ লাখ টাকার। ধার বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বাবদ সুদ ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি আমানত ও ধারের বিপরীতে সুদ ব্যয় করেছে ৫৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ২০১৮ সাল শেষে পরিশোধ করেছে ৬১ লাখ ৪৮ লাখ টাকার। এক বছরের ব্যবধানে সুদব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে সাত কোটি এক লাখ টাকা।
প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ আয়ও কমেছে গত বছরে।

২০১৭ সালে বিনিয়োগ থেকে আয় হয়েছিল পাঁচ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে তা অর্ধেকের বেশি কমে দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ৪২ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে বিনিয়োগ থেকে আয় কমেছে দুই কোটি ৯৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ থেকে আয় কমেছে ৫৫ শতাংশ।

কোম্পানির আয়ের উৎস সঙ্কুচিত হলেও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৫ লাখ টাকার বেশি। অফিস ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে সাত লাখ ১৩ হাজার টাকা। লিজ নেয়া গাড়ির পেছনে এক বছরে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে গাড়ি ভাড়া বাবদ ব্যয় ছিল ২৯ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে তা হয়েছে ৫৫ লাখ ১৬ হাজার টাকা।

ব্যাংক থেকে ধার কমলেও বেড়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে। ফলে ব্যাংকের চেয়ে উচ্চ সুদে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ধার নিতে হয়েছে। বেড়েছে প্রতিষ্ঠানটির আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণের পরিমাণও। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির মন্দ ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪ কোটি ৫১ লাখে। এক বছরের ব্যবধানে মন্দ ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৯ কোটি আট লাখ টাকার বেশি। এর বাইরে ২০১৮ সালে রাইট অফ করা হয়েছে এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা।

নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৮ সালে শেয়ার প্রতি আয় বা ইপিএস হয়েছে ৮১ পয়সা যা ২০১৭ সালে ছিল ৭৫ পয়সা। অথচ ২০১৭ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ইপিএস ছিল ৭৯ পয়সা। ইপিএস নিয়ে ২০১৭ ও ১৮ সালের নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে দুই রকম তথ্য রয়েছে। কোম্পানির অন্যান্য বিষয় ও ইপিএস নিয়ে ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের কোম্পানি সচিব নাজমুল করিমের সাথে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু ব্যস্ত আছেন বলে এ বিষয়ে তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি।

তবে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আ ফ ম বরকত উল্লাহর কাছে দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের পক্ষ থেকে ব্যাংকের সার্বিক বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনিও ব্যস্ততার কথা বলে এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকৃতি জানান।