দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নানা সংকটে থাকা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (পিএলএফএসএল) কার্যক্রম বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আমানতকারীদের পাশাপাশি শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যেও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। যে কারণে পানির দরে কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি করে দিতে চাচ্ছেন অনেক শেয়ারহোল্ডার। কিন্তু ক্রেতার অভাবে হতাশ হতে হচ্ছে তাদের। নামমাত্র অর্থে শেয়ার বিক্রির প্রস্তাব দিলেও ক্রেতার অভাবে বিক্রি করতে পারছেন না শেয়ারহোল্ডাররা।

তবে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড অবসায়ন হলেও তা নিয়ে আমানতকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। প্রতিষ্ঠানটির আমানতের চেয়ে সম্পদ বেশি রয়েছে বলে গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে প্রতিষ্ঠানটি সম্পদের যে হিসাব দিয়েছে, তাতে বড় ধরনের গোঁজামিল রয়েছে। বিগত কয়েক বছরের লোকসানকে সম্পদ হিসাবে দেখিয়েছে আর্থিক খাতের এ প্রতিষ্ঠানটি। পিপলস লিজিংয়ের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এমন তথ্য মিলেছে।

সম্পদ হিসাবে গোঁজামিল থাকায় পিপলস লিজিং অবসায়ন হলে আমানতকারীরা অর্থ ফেরত পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠানটির বর্তমানে আমানত রয়েছে ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সম্পদ রয়েছে ৩ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা।

ডিসেম্বর হিসাব বছর শেষ হলেও ২০১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করেনি অবসায়ন প্রক্রিয়ায় থাকা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের হিসাব পর্যালোচনার জন্য ২০১৭ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, এ সময় প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণ ও অগ্রিম বাবদ

দেখানো হয়েছে ১ হাজার ৪১ কোটি টাকা। এর বাইরে অন্যান্য সম্পদের হিসাবে ১ হাজার ৯১২ কোটি টাকা দেখিয়েছে এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে পূর্ববর্তী বছরের ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকার লোকসানও অন্যান্য সম্পদের হিসাবে দেখিয়েছে। এ ছাড়া জমি ক্রয়ের জন্য অগ্রিম হিসাবে ১২৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা অন্যান্য সম্পদের হিসাবে দেখানো হয়েছে।

এ বিষয়ে শীর্ষস্থানীয় নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান অ্যাকনাবিন-এর সিনিয়র পার্টনার এ এস এম নাঈম দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশের হিসাবমান অনুযায়ী, কোম্পানির পুঞ্জীভূত লোকসান সম্পদের হিসাবে দেখানো যায় না।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিপলস লিজিংয়ের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা জানান, বর্তমান ম্যানেজমেন্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের কাছে মনে হয়েছে সম্পদ ও দায়ে ঘাটতি আছে। এজন্য একটি বিশেষ নিরীক্ষা করানো হয়। এতে দেখা যায় যে, সম্পদ দায়ে ৯০০ কোটি টাকার বেশি ঘাটতি রয়েছে। এটা প্রথম বছর অন্যান্য সম্পদের হিসাবে দেখানো হয়েছে। পরের বছর পুঞ্জীভূত লোকসানও এ খাতে দেখানো হয়েছে। এভাবেই এটা বেড়েছে।

পূর্ববর্তী বছরের এ লোকসান সম্পদের হিসাবে দেখানোর কারণ হচ্ছে, এটা যদি আয় ও লোকসানের হিসাবে চার্জ করা হয়, তাহলে কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয়সহ (ইপিএস) অন্যান্য প্যারামিটারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেহেতু আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিকট ঋণ রয়েছে এবং সেসব ঋণে যাতে সমস্যা না হয়, সেজন্য পূর্ববর্তী বছরগুলোর লোকসান সম্পদের হিসাবে দেখানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, পিপলস লিজিংয়ের সম্পদের হিসাবসহ পুরো দায়-দেনার বিষয়টি নিয়োগকৃত লিকুইডিটর (অবসায়ক) দেখবেন। কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে যদি কোনো অনিয়ম থাকে, তাও সেখানে চিহ্নিত হবে। তারপর প্রকৃত দায়-দেনা হিসাব করে আদালতে পেশ করা হবে এবং আদালতের নির্দেশেই পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, পিপলস লিজিং ২০১৫ সাল থেকে তাদের পূর্ববর্তী বছরের লোকসান সম্পদের হিসাবে দেখানো শুরু করে। সে সময় পূর্ববর্তী বছরগুলোর ৯২৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা পুঞ্জীভূত লোকসান অন্যান্য সম্পদের হিসাবে দেখানো শুরু করে। পরের বছর ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকার পুঞ্জীভূত লোকসান অন্যান্য সম্পদের হিসাবে দেখায় প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৭ সালেও লোকসানের পরিমাণ একই ছিল।

পিপলস লিজিংয়ের ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অডিটর হিসেবে দায়িত্বে ছিল রহমান মোস্তফা আলম অ্যান্ড কোং নামের নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান। পুঞ্জীভূত লোকসান সম্পদের হিসাবে দেখানোর বিষয়ে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কেউ বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি।

নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ ও ব্যবস্থাপনা সংকটের কারণে আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধের ব্যর্থতায় সম্প্রতি পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয় আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন পরিস্থিতিতে আমানতকারীরা পাওনা ফেরত নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরতের বিষয়ে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর ভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানত রয়েছে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রায় ৬ হাজার সাধারণ গ্রাহকের আমানত রয়েছে ৭০০ কোটি টাকার বেশি।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংকে এ প্রতিষ্ঠানের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ৬০৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। যদিও চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, পিপলস লিজিংয়ের নিট সম্পদমূল্য ১ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা ঋণাত্মক রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শন সূত্রে জানা গেছে, পিপলস লিজিং থেকে বিতরণ করা ঋণের অধিকাংশই জালিয়াতির মাধ্যমে সাবেক পরিচালকরা তুলে নিয়েছেন। ভুয়া কাগজ তৈরি করে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ২০১৫ সালে পাঁচ পরিচালককে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এর মধ্যে শুধু প্রতিষ্ঠানের নামে জমি কেনা ও নিজ নামে জমি রেজিস্ট্রি করার মাধ্যমে আত্মসাৎ হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচশ কোটি টাকা। যার মধ্যে একটি জমি ও কিছু অর্থ ফেরত এসেছে।